ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৯৯। বাংলাদেশ সময় রাত ১২ টা ১ মিনিট। ইন্টারনেট জগতে সংযোজিত হলো
এক নতুন ইতিহাস। বাংলা কবিতা প্রবেশ করলো এই অঙ্গনে। কবি সুমন সরদারের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ
'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' সংযোজিত হলো ওয়েব পৃষ্ঠায়। বিশ্বের যে কেউ তাঁর কম্পিউটারে
w.netblityinc.com/book পাসওয়ার্ড ব্যবহারের
মাধ্যমে পড়ে নিতে পারেন এ বইটি।
আমেরিকার এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে বাংলাদেশের দুই তরুণ
netblitzinc. প্রতিষ্ঠা করে এ আপাত: অসম্ভব
কাজটি সম্ভব করে তুলেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের ভাষা সন্ধিৎসুদের নিকটতর করে
তোলার পাশাপাশি বিশ্বের দেশে দেশে জীবন সংগ্রামের কঠোরতার মধ্যে যাঁরা দিনাতিপাত
করছেন তাঁদের নিকটবর্তী করা সম্ভব হলো এই প্রকাশনা জগতের নতুন মাধ্যম উন্মোচন করে।
নেটব্লিজ ইনক আধুনিকতম প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের। এর কর্ণধারদ্বয় চান এ দেশকে,
এ দেশের ভাষা ও সাহিত্যকে পরিচিত করতে সারা বিশ্বব্যাপী। তাঁরা আশা করেন, মানুষ
ভাগ্যান্বেষণে এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন দূর দেশে, সে দেশের মানুষের কাছে বাংলা ভাষা
ও সাহিত্যকে নিয়ে যেতে। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবেই তাঁরা বেছে
নিয়েছেন কবি সুমন সরদারকে। অনুধাবন করা গেছে যে, কবির কাব্য সাধনা এ সময়ের তরুণ
কবির মধ্যে অগ্রণী, প্রতিভার স্পর্শ লেগে আছে যাঁর কবিতায়, সমাজের কাছে আর নিজের
কাজে দায়বদ্ধ যিনি তাঁকে নিয়ে গেলেন তাঁরা ইন্টারনেট ভুবনে, ইতিহাস রচনা করলেন।
শেকড়-সন্ধানী এ কবির জন্যে এটি গর্বের, আনন্দের আর নেটব্লিজ ইনক-এর জন্যে এটি সাহসের
এবং অকুণ্ঠ প্রশংসার।
কবি সুমন সরদার এখন আর অপরিচিত কেউ নন। বিশ্বের লাখ লাখ পাঠক তাঁর কবিতার বই পাঠ
করছেন। প্রতিদিন এ সংখ্যা বাড়ছে। কবি সুমন সরদার এর পূর্বেও অপরিচিত ছিলেন না, তবে
তাঁর পরিচিতির গণ্ডি ছিল কতিপয় পত্রিকার পাঠক আর কবিতাবোদ্ধাদের মধ্যে।
কবি সুমন সরদার বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের গোড়ার দিকে কাব্যজগতে এসেছেন। ১৯৯১ সাল
থেকে বিভিন্ন পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির পাশাপাশি ১৯৯৫ সালে 'বিপন্ন বসবাস'
কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটলো বলে কবি নিজেই স্বীকার করেন। প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি,
সমাজ দর্শন তাঁর কবিতাগুলোকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো। তাঁর কবিতাগুলো নজর
কাড়তে শুরু করলো।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'আগুন রঙের ডানা' প্রকাশিত হলো ১৯৯৬ সালে। এ কাব্যগ্রন্থটি কবি সুমন
সরদারকে নব্বই দশকের তরুণদের মধ্যে অবস্থানকে সুদৃঢ় করলো।
'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' ইন্টারনেটের পাশাপাশি গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে ১৯৯৯ সালের ৫
ফেব্রুয়ারি। প্রকাশ করেছে একমাত্র কবিতার বই প্রকাশক বিশাকা প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন
শিল্পী নাজিব তারেক।
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' কবি সুমন সরদারকে নিয়ে গেলো আরও এক
প্রশস্ত অঙ্গনে। কবি তাঁর নির্মাণ কৌশল আরও উন্নত করেছেন, আরও সচেতন হয়েছেন ছন্দে,
সযতন প্রয়াসে শব্দচয়ন করেছেন, চিত্রকল্প নির্মাণে আরও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কবি সুমন সরদারের সামগ্রিক কবিতা বিশ্লেষণ করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে যা প্রকাশিত
হয়েছে তার মধ্যে কতিপয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যায়।
প্রেম-প্রকৃতি, ক্রোধ-কাম, শূন্যতা-পূর্ণতা, ভোগ-সম্ভোগ কবি সুমন সরদারের কবিতায়
অনিবার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। কবির আকাঙ্ক্ষা এবং সংশয়-
"ফুলের সঙ্গে ভালবাসা করে ভুলে যেতে চাই
ঝাঁজরা পাঁজরে ক্যাকটাসের ঘা
চাইলে কি হয়!"
(বিস্ময় পোকা/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)
ভালবাসা, নিন্দা, বিরহ, যাতনা, দুঃখ, বিষণ্নতা কবিকে নাড়া দেয়। কবি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন
এইসব জাগতিক বিষয়। কবি বারবার এই সমাজেরই একজন হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন। তিনি সমাজ
বিচ্ছিন্ন কেউ নন। অলঙ্করণে কবি দক্ষ। 'বৈপরীত্য' কবিতায় তাঁর দক্ষতার পরিচয় মেলে-
"আকাশের বুক ফুটো করে ওই রোদ হেলে পড়ে
নিরুপায় হয়ে
নিরুপায় হয়ে বৃষ্টির ধ্বনি উড়ন্ত মেঘে উন্মাদ হয়
বারান্দা থেকে
বারান্দা থেকে ঘরে এলে তবু শীতের কাঁপন বাসা বাঁধে ধীরে
পাখিদের মতো
পাখিদের মতো ......."
চিত্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রে কবি সুমন সরদার তাঁর কল্পনার ডানা মেলে দেন। পাঠক তাঁর কবিতা পাঠ করতে
করতে হারিয়ে যান তাঁর কাব্যলোকে, মনের মধ্যে এঁকে ফেলেন এক চিত্র যেমনটি কবি চেয়েছেন-
"আমাদের ঘরে একধরনের ঘুণপোকা আছে
কাঠের তৈরী কোনো কিছু ওর আহার্য নয়
দিন কি রাত্রি, বিকেল গড়ানো স্বপ্নের ঘরে
আকাঙ্ক্ষাপুর থেকে দক্ষিণে অভিমানঘাট
পেরিয়ে দাঁড়াই অসম্পন্নপাড়ের মেলায়
ওদের নীরব উপস্থিতির কানাঘুসা তবু বিশ্রামহীন"
(বিস্ময় পোকা/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)
কবি সুমন সরদার ছন্দ সচেতন। এই কাব্যগ্রন্থের ৪১টি কবিতা এবং উৎসর্গ পত্রের চারটি চরণ সবটাই
ছন্দময়। কবি সুমন সরদার মাত্রাবৃত্তের চমৎকার প্রয়োগ দেখিয়েছেন 'প্রত্যাশা'-সহ বেশ কয়েকটি কবিতায়-
"সফেদ বরফের জমাট তলদেশে মাছেরও সুখ নে
এসব দেখেশুনে সুখের পালকটি সহসা একদিনই
শীতের পাখি হয়ে দখিনে উড়ে যায়।"
কবি সুমন সরদার আলো ও আঁধার নিসর্গ প্রকৃতিকে অবলোকন করেছেন। ফুল ও পাখির জগৎ তাঁর
চেনা; শ্রমশীলতা, প্রেমময়তা, ক্রোধোন্মাদনা, অভিমান এবং প্রতিরোধপরায়ণতা তাঁর জানা।
সহজ-সরল প্রাকৃত জীবন এবং শ্যামলিমার আকর্ষণ যেমন মানব জীবনকে স্নিগ্ধ করে তেমনি কৃত্রিম,
কর্কশ, অস্বাভাবিক জীবনাচরণও তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়। মানুষের হৃদয়বৃত্তি ও সামাজিক
সচেতনতায় সতেজ ও দীপ্ত কবি সুমন সরদার। সমকালীন সমাজের নানা অসঙ্গতি, জটিলতা, কূপমণ্ডুকতা
তাঁর কবিতাকে করেছে সমৃদ্ধ।
মানুষের কল্যাণ ও সুখভোগের জন্য আমাদের সকল আয়োজন ও সকল প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা,
মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং হননের দুই বিপরীত কার্যক্রম সম্পর্কে কবি সুমন সরদার সচেতন।
সৌন্দর্যপ্রীতি, নিসর্গপ্রীতি, নানা উপমা-রূপক ও চিত্রকল্পের সুনিপুণ বিন্যাসে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর বেশ ক'টি কবিতা।
প্রকৃতির রূপলাবণ্য, বৈচিত্র্যে কবি অবিভূত। এইসব ভাবপ্রবাহে কবিতার পরতে পরতে ধারণ
করেছেন কবি সুমন সরদার। এভাবে কবি সুমন সরদারের বেশ ক'টি শিল্পসফল কবিতা নির্মাণে
পারঙ্গমতা পাঠক-সমালোচকদের নজর বেড়েছে।
(উত্তরপুরুষ, প্রথম সংখ্যা ২০০১-এ প্রকাশিত)
* মীর মাহমুদ আলী প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
|