বিষাদ-পরিণতির হাতে সমর্পিত ত্রিদিব দস্তিদারের প্রেম

সুমন সরদার

হোমার পূর্ণাঙ্গ বোধের অনিবার্যতার কথা কবিতাকর্মীদের উদ্দেশে তুলে ধরেছেন। পূর্ণাঙ্গ বোধের বাতাবরণে চিত্তের ইচ্ছার করিডোরে সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সংঘর্ষ অবিরাম। এই সংঘর্ষ কালে কালে হয়ে উঠেছে আরো ঋজু ও লাজুক; আর ঘনত্বের দিক থেকে তা হয়ে উঠেছে সিসার মতো ভারি। 'কল্পনার ভয়াবহতার মধ্যে কবিতার স্থিতি' হিসেবে দেখেছেন অডেন। কল্পনার ভয়াবহতার কূপে বাস্তবতার অনুরণন কাব্যরূপের জন্ম দেয় এবং তা প্রত্যর্পণ করে সময়ের কাছে। বাস্তবতা বোঝাতে কবি আশ্রয় নেন কল্পনার শব্দ কিংবা গল্পের সিঁড়ি। এভাবেই তৈরি হয় রূপকের। রূপকের ব্যবহার এখন আর প্রাচীন আমলের মতো নেই। আধুনিককালে ধর্ম, ধর্মের আবরণ কিংবা ধর্মনিষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতায় রূপক প্রতিস্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই কাজটি সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন।

সত্তর দশকে এসে কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতার কল্পকূপে বাসা বেঁধেছে ব্যতিক্রমী রূপক-

            "... ... অনেক বড় ছোট পিঁপড়ে

            ঢুকে পড়ছে শীতকালীন আশ্রয় খোঁজে

            তরুণ চিত্রকরের ক্যানভাসে

            আমি দেখেছিলাম ফুরফুরে একদিনে

            একটি পিঁপড়ে হামাগুড়ি দিচ্ছিল

            তার পরনে ছিল একটি জলপাই-রঙের ওভারকোট

                        ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...  ... ...

                        একদিন মধ্য দুপুরে একটি পিঁপড়ে

                        মানুষের ফাঁক বেয়ে

                        উঠে এলো ২৪ তলার এক মসৃণ স্বপ্ন-বাড়ির ছাদে"

                        (পিঁপড়ের গল্প / গৃহপালিত পদ্যেরা)

এ কবিতাংশে 'পিপড়ে' বলতে কবি যা বুঝিয়েছেন তা আরো স্পষ্ট হয় 'জলপাই-রঙের ওভারকোট' শব্দত্রয় দ্বারা। সমাজের অশুভ শক্তি এই পিঁপড়ে দখল করে নেয় 'তরুণ চিত্রকরের ক্যানভাস'। এই 'ক্যানভাস' তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে বোঝা গেলেও তা 'সামাজিক সংগঠন'কে বোঝানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করি। পিঁপড়ে 'উঠে এলো ২৪ তলার এক মসৃণ স্বপ্ন-বাড়ির ছাদে' শব্দগুলো দ্বারা সামাজিক সংগঠন দখলই কেবল নয়, প্রতিপত্তি অর্জন করাকেও বুঝিয়েছেন তিনি।

কোনো কবিই তাঁর সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রভাবমুক্ত নন। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সংস্কার প্রভৃতির প্রতি কবি থাকেন সংবেদনশীল। কবি ত্রিদিব দস্তিদার সত্তর দশকের কবি। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুক্তির চেতনায় যেমনি শাণিত হয়েছেন, উজ্জীবিত হয়েছেন; তেমনি উপলব্ধির আগুনে জ্বলেছেন পরবর্তী পর্যায়ের রাজনৈতিক ট্রাজেডি ও কপটতা দেখে। পুরো সত্তর ও আশির দশকে সামাজিক অস্থিরতা ধারণ করে তিনি উপলব্ধির পর্দায় লেপন করেছেন ঋদ্ধানুভূতির রঙ। সেই কারণে কবি ত্রিদিব দস্তিদার তাঁর কবিতায় প্রেম-ভালবাসার পাশাপাশি, এবং হাত ধরাধরি করে কী এক কষ্টে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও চূড়ান্তভাবে জীবন-মৃত্যুর রঙ হিসেবে প্রেম প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থেকেছেন। সমাজ সংসারে শুধু আধুনিক কবিরাই এতে আক্রান্ত হন নি। বাংলাকাব্যের আদিপর্বের চর্যাপদেও সমাজবিন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট বাঙালি জীবনের আত্মবিচ্ছিন্নতাবোধের উচ্চসুর ধ্বনিত হয়েছে। পরবর্তীতে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মনসামঙ্গল কাব্য প্রভৃতিতে ধর্ম ও রাজনীতির প্রভাবে সমাজ জীবনের বিভিন্ন সার্থক বিষয়ের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবোধের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে। এভাবে মাইকেল-এর রচনা পর্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করেছে বিচ্ছিন্নতাবোধের অনল। আধুনিক অথচ ত্রিশপূর্ব কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কিংবা মৃত্যুচিন্তাকে নতুন মাত্রা দান করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। তাঁর মতে, মানবাত্মা ব্রহ্মাত্মারই অংশ। দেহবেষ্টিত আত্মা ইহত্যাগের পর তা সীমাহীন এক পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়। এক কথায় সীমা ও অসীমের সংযোগ সাঁকো হিসেবে মৃত্যু অনিবার্য। "জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম, মরণ তো নহে তোর পর/ আয় তারে আলিঙ্গন কর। আয় তার হাতখানি ধর।" রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কাব্যাংশের মাধ্যমে মরণভীতিকে জীবনের সঙ্গে লীন করেছেন। মৃত্যুকে জীবন ও মহাজীবনের  বিকল্পহীন পথের মর্যাদা দিয়েছেন। জন্ম  ও মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ সমান ভালবাসা দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, জন্ম এবং মৃত্যু একে অপরের পরিপূরক। কবি ত্রিদিব দস্তিদারও রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির রশ্মির আগুনে আজীবন পুড়েছেন এবং জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে প্রেমকে সৌন্দর্যের তিলক পরিয়েছেন। যেমন-

            "তদন্ত হোক জীবনের

            তদন্ত হোক মৃত্যুর

            পোস্টমর্টেমে চাই প্রেম

            G সত্য হোক জীবন এবং মৃত্যুর।"

            (প্রেম-মর্গের ডোম / অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ)

কবি ত্রিদিব দস্তিদার কবিতা নির্মাণের জন্য ব্যবহার করেছেন সরল-সোজা পথ। কখনও কখনও তাঁর কবিতা বিবৃতির আদলে সাধারণ পাঠকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সরল বিবৃতি এড়িয়ে বেশ কিছু কবিতায় তিনি নিয়ে এসেছেন গভীরতা। এক্ষেত্রে গভীরতার তীব্র সংবেদ তাঁর কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। প্রেম অনুভূতি প্রকাশে তিনি কোনো ভণিতার আশ্রয় নেন নি। ভালবাসা নিবেদনে তিনি কোনো ইচ্ছাকৃত অনুরাগ তৈরি করেন নি। প্রেম-ভালবাসা বিষয়ক কবিতার মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের বা মানুষের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন-

            "মারতে মারতে কোথায় নেবে?

            কবি তো ভাই আছেই মরে

            প্রেমিক তো ভাই আছেই মরে

            তোমার প্রেমের যমদুয়ারে"

            (যমদুয়ারী প্রেমিক আমি / ভালোবাসার শাদা ছড়ি)

প্রেমাঘাতের উৎস কোথায়? এ আঘাত কেউ কাউকে দেয় না, কেউ কারো কাছে পায় না। তবু কেন আঘাত? কবি প্রেমাঘাত অভিধাটি প্রকাশ করেছেন শাশ্বতরূপে। 'ভালোবাসার শাদা ছড়ি' কাব্যগ্রন্থের 'শেষ স্টেশন, শেষ বগি'র শেষ দু'চরণে কবি ত্রিদিব দস্তিদার বলেছেন-

            "ভালোবাসার শেষ এবং শুরু দু'টোই অদৃষ্ট, অনিশ্চিতের

            আমাদের, ট্রেন, বগি, স্টেশন ও কাহিনী একান্তই নিজেদের।"

এক্ষণে ভালবাসার আঘাতের জন্য তিনি কাকে দায়ি করেছেন? কিন্তু এখান থেকেই তিনি তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছেন স্বপ্নখনি। কেননা, স্বপ্নও তো নিজের-

                        "তোমায় নিয়ে বৃত্ত আমার

            মধ্যবিত্ত তৃষ্ণা খোঁজে

            তোমার রূপে আবর্তিত

            সকল জল-ধারার মাঝে

            হয় উজানে

            নয়তো জোয়ার ছুটছে কেমন

            উপাসনার সব উপাদান

                        তোমায় ঘিরে

                        ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...

                        ...  ...  ...  ...  ...  ...  ...

                        কিন্তু আমার বৃত্ত যতোই

                        ভালোবাসার চক-খড়ি হায়

                        তবু তোমার অবৃত্ত-প্রেম

                        বৃত্তে আমার স্বপ্ন দেখায়।"

                        (বৃত্ত-প্রেম / ভালোবাসার শাদা ছড়ি)

মেজাজসম্পন্ন একধরনের সরলতায় সোচ্চার শপথে এগিয়ে যেতে ভালবাসতেন তিনি। এক্ষেত্রে ভালবাসার গভীরতর আবেদন ফুটে ওঠে। এ পথ নতুন নয়। তবে তাঁর কবিতার শরীরে রূপকের ব্যঞ্জনায় রসের আদি ঝংকার বাজে।

কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতায় প্রেম বিষাদ-পরিণতির হাতে সমর্পণ করে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে তাঁর যৌবন বেড়ে উঠেছে। সেই সময়ের সামাজিক অবস্থায় তাঁর মননের মধ্যে শৃঙ্খলার হাতছানি এক বেদনাবিধুর ধারণার ভিত্তি তৈরি করেছে। কবি ত্রিদিব দস্তিদারের প্রেমের কবিতাগুলো পাঠান্তে গ্রীক পুরাণের অন্তর্গত অর্ফিয়াসের কথা মনে পড়ে যায়। শিল্পী ও সুরসাধক অর্ফিয়াস গ্রীক দেবতাদের সমগোত্রীয় না হলেও তাঁর মোহন বাঁশির সুরে দোলে উঠতো গাছপালার পত্রাবলী, নেচে উঠতো বনের পশুপাখি। ভালবেসে ইউরিডাইস নামে এক তরুণীকে বিবাহ করলেও সাপের দংশনে তরুণীটির অকাল মৃত্যু হয়। অর্ফিয়াস মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মৃত্যুগহ্বর থেকে প্রেমিকাকে ফিরিয়ে আনতে অর্ফিয়াস তাঁর অপূর্ব সুর মুর্ছনার মাধ্যমে পাতালের রাজা-রাণীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। অর্ফিয়াস পেছনে তাকাবে না এইশর্তে রাজা ইউরিডাইসের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু পশ্চাতে স্ত্রী'র  আর্তচিৎকার শুনে অর্ফিয়াস পেছনে তাকালে ইউরিডাইস চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। আর ফিরতেও পারে নি অর্ফিয়াস। বনদেবীরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে অর্ফিয়াসের দেহ।

গ্রীকপুরাণের এই কাহিনীর আঁধার অংশটি কবি ত্রিদিব দস্তিদারের হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার কর্তৃক ছিন্নভিন্ন লাখো প্রাণের পুনরুজ্জীবন দেখতে চেয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও চেতনাগত পরিবর্তন হয় নি উল্লেখযোগ্যভাবে। তাই তিনি আর ফিরে তাকাতে চান নি ফেলে আসা প্রেমিকসত্ত্বার দিকে। পেছনে ভেসে আসা 'ইউরিডাইস'-এর মতো কোনো আর্তচিৎকার শুনেও তিনি অনড়-

            "যে যাত্রা আমাকে

            তোমার দিকে নিয়ে যায়

            তা অগস্ত্য ............ নৈবচ নৈবচ।

            যে বিত্ত আমাকে

            তোমার দিকে নিয়ে যায়


            তা চিত্তহীন ............ নৈবচ নৈবচ।

            যে অগ্নি আমাকে

                 তোমার দিকে নিয়ে যায়

           তা দীপ্তিহীন ........... নৈবচ নৈবচ।

            যে প্রাপ্তি আমাকে

            তোমার দিকে নিয়ে যায়

            তা অপ্রাপ্ত ............ নৈবচ নৈবচ।

                 যে শ্রান্তি আমাকে

                 তোমার দিকে নিয়ে যায়

                 তা অশ্রান্ত ............ নৈবচ নৈবচ।

                 (নৈবচ নৈবচ / গৃহপালিত পদ্যেরা)

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধের সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies