ভ্রমণ অণুসূচনা
'জেগে ওঠা মানুষের খাদ্যবাহী হাত যায় শিশুর মুখের দিকে/যুদ্ধের দিকে যায় আরেকটি হাত'- সমুদ্র সৈকতে
রণসজ্জার ডংকায় কূপোকাতের ভয় কিন্তু রইলই! এ ভ্রমণ সহজ নয়- কম করে হলেও সাত সমুদ্র ভ্রমণ।
সৈকতে পা পিছলে যাওয়ার কিংবা অথৈ-এ তলিয়ে যাওয়ার ভীতি বুকে জিইয়ে রেখে 'তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সভা শেষ হলে'
তবে স্বস্তি। এ স্বস্তিতে 'কারোই কুড়িয়ে নেবার মতো কিছুই আর থাকে না পড়ে'। তবু 'বাস্তবতা কাকের মতো ওড়ে আর হাহাকার করে'।
সাত সমুদ্র অর্থাৎ সাতটি সমুদ্র। আর সমুদ্রগুলোর নাম হলো- রোদ ঝলসানো মুখ, স্বপ্নমঙ্গল কাব্য,
এখনো উত্থান আছে, চোখে চোখ রেখে, একাকী রৌদ্রের দিকে, শেকড়ের শোকে এবং ঘাসপাতার ছুরি।
এ সমুদ্র প্রকৃত অর্থে সমুদ্র নয়, তবে সমুদ্রের মতোই এগুলোর মর্মবিস্তার। 'সাত সমুদ্র' স্বধার্য হলেও
বেমানান নয়। অন্তত আমার এই মনে হয়েছে যৎসামান্য সঞ্চয় নিয়ে এমন ভ্রমণে বেরিয়ে।
বিস্ময় প্রপাতসমূহ ওঁৎ পাতে কাব্যদেহে
সাদামাটা বিচারে কবি সমুদ্র গুপ্ত'র কবিতা প্রায় একপেশে এবং রাজনৈতিক রসাচ্ছাদিত এক প্রকার
দ্রোহ। কিন্তু দ্রোহ প্রকাশের কারণ ও মাধ্যম বিবেচনায় তা শুধুমাত্র একপেশে বললে অত্যুক্তি হবে।
বাঁচবার আকুতি থেকে তাঁর কবিতায় কেবল দ্রোহী হয়ে ওঠে নি সমুদ্রের ঢেউ; জীবনঘনিষ্ট অনুসঙ্গের
হাত ধরাধরি করে নান্দনিক সৌন্দর্যও হাঁটাহাঁটি করে তাঁর কবিতার ব্যপ্ত সড়কে। কবি সমুদ্র গুপ্ত
বিশ্বাস করেন, সুস্থ ও প্রলেতারিয়েত গোষ্ঠীর পক্ষের রাজনৈতিক চেতনার প্রয়োগ ছাড়া জীবনশিল্পের মুক্তি
নেই। আর তিনি সেই চেতনা ব্যবহারে সরাসরি কিংবা নানান উপমায় কবিতার শরীরে যে নির্মিতির
কারিশ্মা দেখিয়েছেন তা পাঠকের অনুভূতিতে নাড়া দেয়।
ষাট দশকের অন্যতম কবি সমুদ্র গুপ্ত তাঁর 'সাত সমুদ্র'-র ঢেউয়ের পরতে পরতে পরিয়েছেন অলঙ্কার,
শব্দালঙ্কার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শিল্পায়ণে' লিখেছেন, "স্বর্ণাদি অলঙ্কারগুলি যেমন মানুষের শোভা বর্ধন
করিয়া আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে, সেইরূপ অনুপ্রাস, উপমা প্রভৃতি অলঙ্কারগুলি কাব্যদেহ অর্থাৎ শব্দ ও
অর্থে বর্তমান থাকিয়া শব্দার্থের অত্যন্ত শোভা সম্পাদন করিয়া কাব্যের আত্মাস্বরূপ রস বা ভাবাদির
উপকার করিয়া থাকে।"
কবি সমুদ্র গুপ্তও তাঁর কবিতায় অলঙ্কার ব্যবহার করে কাব্যদেহের শ্রীবৃদ্ধি করেন অনায়াসে।
তিনি তাঁর দ্রোহ, স্বপ্ন, আশা-নিরাশা, ব্যথা-বেদনা কিংবা প্রকৃতিবিষয়ক কাব্য-শরীরের
সুডৌল শয্যায় শায়িত করেন প্রতীক, উপমা, অনুপ্রাস। এতে করে তাঁর অধিকাংশ কবিতায় ফুটে
ওঠে এক চিরন্তনী ভাবধারা। মাঝে মাঝে শব্দের দ্বিত্ব ব্যবহার কিংবা একই অংশে একই শব্দের
একাধিক ব্যবহার এ ভাবধারাকে আরও সমৃদ্ধ করে, গভীর করে। তাঁর কবিতার শরীরে যতি চিহ্নের
অভাব এক বিশেষত্ব প্রদান করেছে।
বুভুক্ষু জিহ্বায় দ্রোহের আগুন
এ ভ্রমণে অদেখা আগুন দেখে চমকে উঠেছি। অচেনা ফুল দেখে পুলকিত হয়েছি। আর অন্যদিকে দেখেছি,
'রোদ ঝলসানো মুখ' স্বপ্ন দেখতে দেখতে উত্থানের প্রত্যাশায় 'একাকী রৌদ্রের দিকে' চেয়ে চেয়ে
'শেকড়ের শোকে' জন্ম নেয়া 'ঘাসপাতার ছুরি'। এ ছুরির বিপরীতে বুভুক্ষু জিহ্বায় দ্রোহের
আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক। এ দ্রোহ অলীক নয়, অনিবার্য।
বরফের স্তন থেকে
বুভুক্ষু জিহ্বার টানে উঠে আসে খুন"
(একটি শিশুর জন্য/রোদে ঝলসানো মুখ)
বিত্তবৈভবের দেশ বিবস্ত্র যেন, বুভুক্ষু সন্তানের জন্য দ্রোহের আগুন জ্বলে তাই এভাবে-
"প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ের বিপরীতে সামাজিক ঘূর্ণিঝড় চাই
চাই সেই বেগবান বায়ু
যে বাতাসে পত্রবৎ উড়ে যাবে ঘৃণ্য মানুষ তার শিকড় সমেত"
(আমার স্বপ্ন এখন/রোদে ঝলসানো মুখ)
স্বাধীনচেতা কবি সমুদ্র গুপ্ত ভেঙে ফেলতে চান সকল প্রকার অশুভ আগল। রক্ত প্রপাতের সিঁড়ি বেয়ে
বুকের মধ্যে বসাতে চান আলোক-পৃথিবী। যে পৃথিবীর স্নায়ুর ভেতরে ভেতরে সর্বদা সশস্ত্র আগুন
আগুন রোদ। যে রোদ স্নানরত থাকবে শান্তিবৃষ্টির কোলে। রাত্রির ট্রাকের মতো পাহারা বসাবে
ভালবাসা। তাই সমুদ্রসমান আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করে কবি গাইতে থাকেন অবিরত সৌন্দর্যের গান, জীবনের গান-
"যেনো, শতাব্দী শতাব্দী ধরে এইসব
জমে ওঠা দুঃখ আর রক্তের মধ্য থেকে
ধানের চারার মতো উঠে আসছে জীবন
এবং
চতুর্দিকে ঝলসানো এই জনযুদ্ধ
যুদ্ধ আর দুঃখ আর রক্তপাত থেকে
আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের দিকে"
(জীবনের দিকে/রোদে ঝলসানো মুখ)
প্রজাপতির স্বপ্নডানায় পুষ্প ফোটে
"স্বপ্ন এসে টোকা দিলে
টোকা শুনে কপাট খুললে
স্বপ্নের অশ্ব এসে পিঠ পেতে দেয়
.....................................
হোক ক্ষীণকণ্ঠ তবু
একদিন স্বপ্ন এসে ডাক দেবে"
(সেইদিন/স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
এরকম মানবিক স্বপ্নবোধের জাল ছড়িয়ে দিয়েছেন কবি 'সাত সমুদ্র'র বুকেপিঠে। প্রজাপতির স্বপ্নডানায়
পুষ্প ফুটিয়ে কবি গেয়েছেন অপার সৌন্দর্যবোধের গান এবং বুভুক্ষু জাতিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন
তিমিরবিনাশী আশার আলোর দিকে। কিন্তু এতো স্বাপ্নিক আশা রাখবেন কোথায় কবি! এতো আলো
ছড়াবেন কী করে এতটুকুন উঠানে! পুষ্পের এতো গন্ধ নিতে প্রজাপতির ডানা উড়বে তো! কবি নিজেই যখন
বলেন-
"আমাদের ধূলি ও মাটির ছোট ঘরে
স্বপ্ন এসে থানা গাড়লে আমাদেরই থাকার জায়গা থাকে না
স্বপ্ন এলে ঘাটতি পড়ে কাঁথা বালিশ চাটাই
খাবার বাসন বাটি"
(স্বপ্নের ঘুঘু/স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
তখন কবি আর কীভাবে বোঝাবেন, এই বুভুক্ষুর দেশে এতো আশা-আলো-গন্ধ এসে পাত্রহীন ঘোরে
মাঠে-লোকালয়ে আর 'স্বপ্নের ঘুঘু এসে তাও খেয়ে যায়'। কিন্তু অন্যদিকে কবি সমুদ্র গুপ্ত'র
ব্যক্তিজীবনে স্বপ্নের আগমনে কাঁথা, বালিশ, চাটাই, বাসন-বাটির ঘাটতি পড়ে নি। তিনি এখনো
পুষেন অনেক বড় বড় স্বপ্ন।
স্বপ্নের দেশে স্বপ্ন আসে। স্বপ্নের দেশের
মানুষগুলো আরেক স্বপ্নে মগ্ন। উপুড় করা স্বপ্ন-হাত ঠেলে দিয়ে প্রিয়তমার আদলে কে যায়
অন্য স্বপ্নের দিকে! কবি সমুদ্র গুপ্ত নিবিড় শৈল্পিক ছোঁয়ায় স্বপ্নের ছবি এঁকেছেন 'সাত সমুদ্র'র পাঁজরে
পাঁজরে। কবির আক্ষেপ যখন এই-
"আমি আমার স্বপ্নের কথা আদ্যোপান্ত খুলে বল্লুম তবু
দুঃস্বপ্ন আমার পিছু ছাড়লো না
.........................................
লজ্জা ঘৃণা আর দুঃখক্লিষ্ট হাতের মতো বারবার
স্বপ্নকে লুকিয়েই ফেলে রাখতে হয়
দম বন্ধ স্বপ্নেরা কি এভাবেই
দুঃস্বপ্নের ভয়াল আকাঙ্ক্ষার আহুতি হবে"
(আমার স্বপ্নের কথা/স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
তখন মনে হয় কবি পালাতে চান দুঃখ করে। এ দুঃখ মানুষের জন্য মানুষের। সেই মানুষকে তো তিনি কম
আকুতিতে ডাকেন নি-
"একমাত্র তুমি না আসার কারণেই
এতোসব ঘটনা ঘটে, ঘটতেই থাকে"
(তোমার জন্যেই/স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
আগল আঁটা ক্ষীরের বাটি
কবি সুন্দরের পূজারী। সৌন্দর্যবোধ কবিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় আগল আঁটা দেশের গোপন ক্ষীরের
বাটির দিকে। যে বাটিতে অবহেলিত মমতাময়ী কাঁচা কাঁচা বিত্তবৈভব। কবি তাই দ্রোহ করেন, অশুভের
পায়ে গুড় ছিটিয়ে পিঁপড়ে লেলিয়ে দিতে চান, দেখতে পান আগলের ওপাশে ক্ষীরের বাটিতে রোদ
জ্বলা প্রস্তুতির বিশাল আকাশ। ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা কবিকে বিজয়ের বিপুল আভাস উপহার দিতে
চায়। তাই সন্তর্পণে এগুতে চান কবি কখনও কখনও-
"বারবার শেষ হয় অতিচেনা ক্লান্তিঘেরা বাড়ির দরজায়
হায়রে সেই গুণে গুণে পা ফেলাহায়রে সেই গুণে গুণে পা ফেলা
সেই আমারই ঘামে ভেজা ঠাণ্ডা কড়া নাড়া"
(একটি মুহূর্তের কবিতা/এখনো উত্থান আছে)
এ কড়া নাড়া চলবে আর কতদিন! ঘুমন্ত মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠবে কবে! আগল ভাঙতে কি তবে
পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ! অনেক পথতো বটেই! কবিই বলেন-
"এসব নিয়েও দীর্ঘ এপথ পাড়ি দিতে হবে জানি
কানের কাছে স্মৃতি ও চিন্তা করে এসে কানাকানি"
(অনড় গন্তব্যের দিকে/এখনো উত্থান আছে)
প্রেমের প্লাবনে নুহের নৌকা
সমুদ্রের ঢেউ এক অনাবিল ভালবাসা জানাতে আছড়ে আছড়ে পড়ে সৈকতের দিকেজ্জযেখানে রমণীরা স্নানরত
কিংবা স্নানযাত্রায় বিহ্বল! উত্তাল ঢেউয়ে ক্রোধ আছে, এর মধ্যেও নুহের নৌকার মতো প্রেমময় অধরোষ্ঠ
সজাগ কখনও কখনও। কিন্তু চূড়ান্ত পাওয়া হয় কি! কবি নিজেই যখন বলেন-
"এ সবগুলোই সত্য
অর্থাৎ কিনা
আমি আছি এটা সত্য
এবং
আমি নেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না
(রাজনীতি ১৯৮৭/চোখে চোখ রেখে)
তখন নিশ্চয়ই পলায়নবৃত্তিতে নীরব কবি! তবে কি কবি সেই ভালবাসার ঢেউয়ে দেখতে পান সুঁচালো দাঁত?
তাই নুহের নৌকার ভরসা কখনও কখনও অর্থহীন মনে হয়? এরপর কবির উপলব্ধি ভিন্নতর-
"বুঝতে পেরেছি আজ
ক্ষুধার্তের অন্নের মতো বাইরের আলো খোঁজার আগে
নিজের ভেতরে অন্তত
একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বালানো বেশি প্রয়োজন"
(প্রয়োজন/চোখে চোখ রেখে)
কবি নিজের উপলব্ধির আগুনে ক্ষীণ, ন্যুব্জ! যাতে অন্য মানুষের একই উপলব্ধি জন্মায় এ বিষয়টিই তিনি পক্ষান্তরে বলতে চেয়েছেন।
প্রেমেও দ্রোহ আছে। প্রেমও দ্রোহের মাধ্যম হতে পারে। কিংবা প্রেম আছে বলেই দ্রোহ
আছে। চোখে চোখ রেখে তিনি তাই বলতে চেয়েছেন- যা সাত সমুদ্রের ফণায় ভেসে বেড়ায়।
হঠাৎ আঁধারে যাত্রাভঙ্গ
'সাত সমুদ্র' নিবিড় ভ্রমণের সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। এই কৈফিয়তকে সম্বল করেই 'রণে ভঙ্গ' ছাড়া
উপায় নেই। 'সাত সমুদ্র'র ২০৬ নং পৃষ্ঠায় 'কেন নেবে' কবিতায় যখন পড়ি-
"আমরা কিন্তু
কেবলই বৃত্তের মধ্যে আরো বেশি বৃত্ত এঁকে চলি
বৃত্তের ভিতর থেকে
রেখাদের নাম ধরে ডেকেরেখাদের নাম ধরে ডেকে
বৃত্তের অংশ কেন বের করে নেবে কেন নেবে"
তখন ভ্রমণ থমকে যায়। সাহস হয় না আর চলার। কেবলই মনে হয় বৃত্তের অংশ ধরে টানাটানি খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
কবি সমুদ্র গুপ্ত মনস্তাত্ত্বিক সংকটগুলোকে আলতোভাবে তুলে এনে এদের এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, এতে
পাঠকের মনে অগ্রসর চেতনা ভর করে এবং তৈরি হয় আরেক মনস্তাত্ত্বিক সংকট। এ কেবলমাত্র চিন্তাশীল
পাঠকের বেলায়। শিল্পসম্মত উপস্থাপনে সাত সমুদ্রের নোনা জলরাশি বড়ই মিঠেল হয়ে উঠেছে। তাই
আঁধারেও ঢেউয়ের ফণায় জ্বলে ওঠে আলোর ফোয়ারা। কেননা, কবি সমুদ্র গুপ্ত'র কবিতায় সমাজবোধ
ও শিল্পবোধ-এর যুগপৎ যাত্রা বড়ই প্রাণবন্ত।
কবি সমুদ্র গুপ্ত'র কবিতার মূল উপজীব্য মানুষ, মানুষ এবং মানুষ। তা কখনও প্রকৃতি, কখনও প্রেম,
কখনও ক্ষুধা, আবার কখনওবা স্বপ্ন-আশা-অভিমান এরকম অনেক কিছু অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ সকল
অনুষঙ্গ ভাবনার পেছনে আত্মসচেতনতা, নৈর্ব্যক্তিকতা, বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের হতাশা, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের
হাহাকার, হতাশা-হাহাকার থেকে জন্ম নেয়া অবক্ষয় পটভূমির কাজ করেছে। তিনি কবিতা লেখেন মানুষের জন্য
এটাই সত্য, চূড়ান্ত সত্য!
|