কাব্যালোচনার জন্যে কেউ কবিতার নির্মাণশৈলীর চমৎকারিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান। আবার
কেউ কবিতার আত্মা অনুসন্ধানে মনোযোগ দিতে চান। কেউ বা মনে করেন, কবির দেশ, সময়,
সমাজব্যবস্থা, কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা, প্রতিভার মাত্রা প্রভৃতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে কবিতার সমগ্র
তাৎপর্য উদ্ধার সম্ভব। কবি নাসির আহমেদের কবিতা আলোচনা করতে এর যে কোনো মত গ্রহণ করলেই
তাঁর কবিতার নিগূঢ় প্রদেশে অবগাহন করা যায়। কেননা তিনি কবিতা নির্মাণে আজীবন সহজাত। সহজাত
ভঙ্গিতেই রচিত তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ছন্দ, চিত্রকল্প, বাক্-ভঙ্গি এবং বিন্যাসের কারুকাজ।
সহজাত গুণটির সঙ্গে শিল্পভাবনার পরিপক্কতা তাঁর কবিতায় যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। বাংলা কবিতা এক
জায়গায় থেমে নেই। সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে কবিতার বিষয় ও নির্মাণশৈলীর পরিবর্তন ঘটেছে। কবি
নাসির আহমেদ এ দু'স্তরেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন সফলভাবে।
কবি নাসির আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আকুলতা শুভ্রতার জন্যে' (১৯৮৫) থেকে 'আমি স্বপ্ন
তুমি রাত্রি' (১৯৯১) পর্যন্ত চারটি কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য প্রেম ও উজ্জ্বল দিনের আকুতি। 'বৃক্ষমঙ্গল'
(১৯৯৬) কাব্যগ্রন্থে এসে পূর্ববৈশিষ্ট্যের মধ্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বিষয়, ভাব ও নির্মিতিতে এক
লক্ষণীয় বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা। আর অষ্টম কাব্যগ্রন্থ 'বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে' (২০০০)-এ
এসে নাসির আহমেদ অন্য এক কবি-ব্যক্তিত্ব। এখানে এসে এমন এক বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা যে,
তরুণতম কবির শিল্পভাবনার অগ্রভাগে তিনি অবস্থান করছেন। এ কার্যকরী পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে তাঁর
স্বভাবজাত কবিত্বশক্তির কারণে। প্রধানত তিন পর্বের প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থগুলিতেই তিনি খেলেছেন নানা
ভাব-বিষয়ের খেলা। পরের পর্ব পূর্বের চেয়ে পূর্ণতা পেয়েছে এমন সরলীকরণের কোনো সুযোগ নেই।
এ পর্ব বিভাজন তাঁর কাব্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। কি শিল্পভাবনায়, কি বিষয়ে, ছন্দে, চিত্রকল্পে
কিংবা নির্মিতির কারিশ্মায় তিনি ব্যাপক পাঠক ও সমালোচকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন।
নাসির আহমেদ-এর কবিতার মূল সুর প্রেম। কবিতায় প্রেম অনুষঙ্গের প্রতি তাঁর যে তন্ময়তা তা
সাধারণ পাঠকের অনিবিড় পাঠেই ধরা পড়ে। কিন্তু নাসির আহমেদ-এর সমগ্র কবিতা পাঠে এমত
সাদামাটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ডি এইচ লরেন্সের সমগ্র রচনার শেকড়েই
যৌন-মিলনের প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে এসেছে। কিন্তু লরেন্সের রচনায় যৌনতার সহজাত
পথের আড়ালে কিংবা তলদেশে পৌঁছলে আর এক ঈঙ্গিতপূর্ণ রহস্যঘেরা জগত দেখতে পাওয়া যায়। এর
আলোতে অবগাহন করে দিক্ভ্রান্ত জীবন পায় সত্যের ভিত্তি। নাসির আহমেদ-এর কবিতায় ডি এইচ
লরেন্সের রচনাশৈলী অনুপস্থিত থাকলেও গভীরতার নিশ্ছিদ্র আলয়ে ঈঙ্গিতপূর্ণ রহস্যতা উপস্থিত। তিনি
প্রেমের কবিতার আড়ালেও রেখে যান ইহ ও পরলৌকিক যুগল সুর-মুর্ছনা।
অনেক সমালোচকের দৃষ্টিতে কবি নাসির আহমেদ প্রেমিক-কবি। তিনি ব্যক্তি হিসেবে কতটুকু
প্রেমিক, তার উপস্থাপনা আপাতত: আমাদের বিবেচনা বহির্ভূত। কিন্তু কাব্যক্ষেত্রে তাঁর
আত্মোপলব্ধির বাতাবরণে যে রশ্মি ছড়িয়েছেন তার চুলচেরা বিশ্লেষণে কারও কার্পণ্য গ্রহণযোগ্য
নয়। নাসির আহমেদ-এর কাব্য নিরীক্ষায় এক গোপন বার্তা ধরা পড়ে। তিনি কবিতার চরণে ভর করে
যাই বলতে চান না কেন, যে বিষয়কেই স্পর্শ করুন না কেন তাতে থাকে এক ধরনের প্রেমের প্রলেপ।
নিটোল ভালবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দ্রোহ, নিসর্গ, মৃত্যুচেতনা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,
জীবনের জয়গান, দার্শনিক অভিজ্ঞতা, নস্টালজিক আবহ প্রভৃতি তাঁর কবিতার রূপবৈচিত্র্য হিসেবে
আমাদেরকে আন্দোলিত ক'রে এক সুখ-বিষণ্ন অন্তরালে ঠেলে দেয়।
প্রেমার্ত কবি নাসির আহমেদ নারীর প্রয়োজনকে কাব্যভাবনায় নিয়ে এসেছেন সুন্দরভাবে। চাদরের
প্রতীকে নারী বা প্রেমিকা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা এরকম-
"তবু যেন গ্রীষ্ম নয়, বর্ষা বা শরৎ নয়, বসন্তও নয়
আমার অস্তিত্বে এই চরাচর শুধু সেই শীতার্ত প্রান্তর-
ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মতো অপ্রাপ্তির দুঃসহ বরফ
আদিগন্ত জমে ওঠে নিত্য যার বুকে
আর সেই সহ্যাতীত শীতে
একান্ত চাদর ছাড়া বিকল্প পোশাক নেই কোনো।"
(শীতার্ত চরাচরে / আকুলতা শুভ্রতার জন্যে)
কাব্যচর্চার প্রথমভাগে রচিত এই কবিতার বিষয়বস্তুতে তিনি অনড় থেকেও বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা।
চাদরের বিকল্প কোনো পোশাক তাঁর ছিল না। এই চাদরের বিকল্প এখনো তাঁর নেই। আর এ সময়ের চাদর
হলো তাঁর কাব্যে নিত্যনতুন বিষয়ে সৌন্দর্যভাবনা।
কবি নাসির আহমেদের প্রেমিকসত্ত্বার আকুলতা শুধু নারী ও ভালবাসার প্রতি নয়। তাঁর ভালবাসা উথলে
উঠে আলিঙ্গন করে নন্দতত্ত্বের চিরকালীন মেঠোপথ। নিষ্ঠুরতা তিনি পছন্দ করেন না, পছন্দ করেন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ থেকে তাঁর ত্যাগী মনোভাবের বৈশিষ্ট্যও প্রকাশিত হয়-
"গোলাপ ছিঁড়ে নেয়া নিষ্ঠুরতা নেই
আমার এই হাতে
তবে কি শূন্যতা হৃদয়ে এতকাল? রিক্ত থাকে টব
এমন দিনে রাতে?
ফুটলে ফুল কিছু তোমরা ছিঁড়ে নিও।
আমিতো মুগ্ধতা দু'চোখে মেখে শুধু
তৃপ্ত চিরদিন দৃশ্যে, গন্ধেই
যেমন কবি তার কাব্য-লক্ষ্ণীকে সাজিয়ে মুগ্ধ সে
স্বপ্ন-গহনায়; প্রণয়ী আমরণ শব্দে-ছন্দেই।"
(ফোটাতে দাও ফুল / আকুলতা শুভ্রতার জন্যে)
পূর্বেই বলা হয়েছে, 'বৃক্ষমঙ্গল' গ্রন্থে এসে তাঁর কবিতা নতুন কাব্যভাবনায় উপনীত
হয়েছে। বহুপথ হেঁটে তিনি ক্লান্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বৃক্ষছায়ায়, সমর্পণ করেছেন চিরসবুজ
প্রকৃতির কাছে। এ সমর্পণ বৃক্ষসৌন্দর্যতত্ত্বের পত্তন ঘটিয়েছে-
"বহুদূর থেকে আজ এসেছি এখানে এই জোনাক বাগানে
দীর্ঘ ধু ধু পথে সুরকি-কাঁকরে
বিক্ষত পায়ের চিহ্নে পথের দূরত্ব লেখা আছে
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
ঠোঁটের উষ্ণতা দাও, ক্লোরোফিলে সিক্ত করো
চুম্বনবঞ্চিত দাহ- অনল পিপাসা
দীর্ঘ অনিদ্রার জন্যে লতাগুল্মে পাতা ও পল্লবে
নিবিড় রাত্রির শয্যা বিছাও এবার।"
(বৃক্ষমঙ্গল : ১ / বৃক্ষমঙ্গল)
এই 'দীর্ঘ অনিদ্রার জন্যে' 'নিবিড় রাত্রির শয্যা বিছাও এবার'-এর অভ্যন্তরে মৃত্যু কিংবা আত্মবিচ্ছিন্নতার সুর ঝংকৃত।
কবি নাসির আহমেদ তাঁর সমগ্র কাব্যকর্মের সিঁড়িতে প্রেম-ভালবাসার মোচড়ে মোচড়ে
বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হয়েছেন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কখনও কখনও তীব্র হয়ে মৃত্যুচিন্তাকে
প্রশ্রয় দিয়েছে। তাঁর এই মৃত্যুচিন্তাকে নতুন মোড়কে সাজিয়েছেন কাব্যকলার সিঁথানে। মৃত্যুচিন্তার
নবরূপায়নে তিনি একজন নিরন্তর শব্দশ্রমিক। কাব্যপ্রেম দিয়ে আত্মবিচ্ছিন্নতা কিংবা মৃত্যুচিন্তাকে
সজ্জিতকরণের ব্যাপারটি অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের প্রথম ধাপে উঠে আসতে সময়ের ব্যাপারমাত্র।
জন্মের সঙ্গে মৃত্যুর একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে। এটাই প্রকৃতির
সাধারণ নিয়ম। আর এ রকম একটি মৌলিক বিষয়ের কাব্যপ্রিয়তা পাওয়া সহজাত। সময়ের সঙ্গে উপলব্ধির
রূপবদলে কবিকূল চলমান থাকবেন- এটাই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে নিরন্তর প্রবাহিত বাদানুবাদের
অনেক জরুরি বিষয় উত্থাপন করেন মনীষীগণ।
কোনো কবিই তাঁর সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রভাবমুক্ত হতে পারেন না। রাজনৈতিক, সামাজিক,
অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সংস্কার প্রভৃতির প্রতি কবি থাকেন সংবেদনশীল। কবি নাসির আহমেদ
সত্তর দশকের কবি। তিনি তাঁর সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখে মুক্তির চেতনায় যেমনি শাণিত
হয়েছেন, উজ্জীবিত হয়েছেন; তেমনি উপলব্ধির আগুনে জ্বলেছেন পরবর্তী পর্যায়ের রাজনৈতিক ট্রাজেডি ও
কপটতা দেখে। পুরো সত্তর ও আশির দশকে সামাজিক অস্থিরতা ধারণ করে তিনি উপলব্ধির পর্দায় লেপন
করেছেন ঋদ্ধানুভূতির রঙ। সেই কারণে কবি নাসির আহমেদ তাঁর কবিতায় প্রেম-ভালবাসার পাশাপাশি,
এবং হাত ধরাধরি করে কী এক কষ্টে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও চূড়ান্তভাবে মৃত্যুর রঙ
নির্ধারণে ব্যস্ত থেকেছেন। সমাজ সংসারে বসতবাড়ি নির্মাণ করে শুধু আধুনিক কবিরাই এতে
আক্রান্ত হন নি। বাংলাকাব্যের আদিপর্বের চর্যাপদেও সমাজবিন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট বাঙালি
জীবনের আত্মবিচ্ছিন্নতাবোধের উচ্চসুর ধ্বনিত হয়েছে। পরবর্তীতে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য,
কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মনসামঙ্গল কাব্য প্রভৃতিতে ধর্ম ও রাজনীতির প্রভাবে সমাজ জীবনের
বিভিন্ন সার্থক বিষয়ের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবোধের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে। এভাবে
মাইকেল-এর রচনা পর্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করেছে বিচ্ছিন্নতাবোধের অনল। আধুনিক অথচ ত্রিশপূর্ব
কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কিংবা মৃত্যুচিন্তাকে নতুন মাত্রা দান
করেছেন। তবে এও সত্য যে, উপর্যুপরি যুদ্ধ-বিগ্রহে পরাজয়ের ফলে হিন্দুমানসে নিস্ক্রিয় অবসাদ
এবং বাউলতত্ত্বের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মৃত্যুচিন্তা যে রূপ পরিগ্রহ করে তাতে রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন ঋদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। তাঁর মতে, মানবাত্মা ব্রহ্মাত্মারই
অংশ। দেহবেষ্টিত আত্মা ইহত্যাগের পর তা সীমাহীন এক পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়। এক কথায় সীমা
ও অসীমের সংযোগ সাঁকো হিসেবে মৃত্যু অনিবার্য। "জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,
মরণ তো নহে তোর পর/ আয় তারে আলিঙ্গন কর। আয় তার হাতখানি ধর।" রবীন্দ্রনাথ তাঁর
এই কাব্যাংশের মাধ্যমে মরণভীতিকে জীবনের সঙ্গে লীন করেছেন। মৃত্যুকে জীবন ও মহাজীবনের
বিকল্পহীন পথের মর্যাদা দিয়েছেন। জন্ম ও মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ সমান ভালবাসা দিয়ে প্রমাণ
করতে চেষ্টা করেছেন যে, জন্ম এবং মৃত্যু একে অপরের পরিপূরক। কবি নাসির আহমেদও
রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির রশ্মির আগুনে পুড়েছেন কখনও কখনও। যেমন-
"আমার জন্ম এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে
রূপান্তর ; এক নাম থেকে শত নামে।
আমি সেই অবিনাশী অদৃশ্য বাতাস
জন্ম-পুনর্জন্ম নিয়ে চলেছি অনন্ত-অসীমে,
আমার মৃত্যু নেই |