শিল্পসম্মত কাব্য-নির্মিতি স্রষ্টার প্রক্রিয়াজাত হলেও তা পাঠের মধ্য দিয়ে একজন পাঠক কোনো না কোনো দুর্বলতা ধরার চেষ্টা করতে
পারেন। এ দুর্বলতা সৃষ্টির নয়, এ দুর্বলতার গলিপথে পাঠক সৃষ্টির বা শিল্পের মর্মার্থ নিজের মতো করে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে চেষ্টা
করেন। শিল্পের যে মাধ্যমেই হোক, বিষয়টি পাঠক বা অবলোকনকারী নিজস্ব উপলব্ধির গলিপথে হেঁটে হেঁটে এর মর্ম উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন।
রূপক-প্রতীকের সাহায্যে কবিতার আড়াল পাঠকের চোখে যে পর্দা টেনে ধরে তা ছিন্ন করতে প্রকৃত পাঠকের চেষ্টার
কমতি থাকে না। যে কোনো কবিতা নিংড়ে রস বের করে নিতে পাঠক এক প্রকার পুনঃনির্মাণের পথে অগ্রসর হন। এতে
নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পাঠকের এই পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়ার পথে কবিতাটি পাঠকের জন্য হয়ে ওঠে পুনরাবিষ্কার
কিংবা পুনরুৎপাদন। পাঠকের এ বিষয়টি ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন পাঠ নয়; কাল, সমাজ, শ্রেণীচেতনা, ইতিহাস
প্রভৃতি থেকে আহরিত জ্ঞানের এক বুদ্ধিদীপ্ত ছায়ার সমষ্টি। কবি যে বিষয়কে পুঁজি করে কবিতা নির্মাণ করেন, পাঠক
তাঁর নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি জুড়ে দিয়ে ভিন্নতর বা উচ্চতর বিষয়কেও আহরণ করতে পারেন। এটাই পাঠকের পুনরাবিষ্কার
বা পুনরুৎপাদন।
সত্তর দশকের কবিদের কবিতা আলোচনায় উপরি উক্ত ভূমিকার অবতারণা এক কঠিন সমস্যার জালকে ছিন্ন করার জন্যে।
এই দশকে আবির্ভূত হয়েছেন বহুধাবিভক্ত কবিত্বশক্তি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভগ্নস্তূপ থেকে জন্ম নেয়া সামাজিক উপলব্ধি এর
মূল। 'স্বাধীনতা'কে সত্তরের কবিগণ বিচিত্র করে তুলেছেন নানা রঙে। স্বাধীনতা এবং ভগ্নস্তূপ থেকে উঠে আসা মানবিকতা
এবং এর বাইরের সংঘাতে সৃষ্ট নানা জটিলতা ও আবেগের সংগ্রামজাত বাস্তবতা মিশে আছে সত্তরের কবিতায়।
সত্তরের কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য কবি মুজিবুল হক কবীরের কাব্যশিল্প বিনির্মাণের থাকে থাকে জমা থাকে সৌন্দর্যময়তা।
ছন্দের বহুমাত্রিক ব্যবহার, দেশজ শব্দাবলী, মিথ, রূপক, চিত্রনির্মাণ প্রভৃতি তাঁর মূল শিল্পস্বভাবকে আবিষ্কারের
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও এক্ষেত্রে এই-ই শুধু পথ নয়। তাঁর কাব্য নির্মাণে অনায়াস ভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও
কাব্যের অন্তর্গত বিষয় বা ভাব ঘনীভূত। তবে সাধারণত কবিতার গভীর আড়ালের জটিলতায় তিনি নিমজ্জমান নন। ছন্দ
ও লিরিকধর্মীতা তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য। ভাবগভীরতায় পরিপুষ্ট শব্দরাজি এমন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কবিতায় তিনি
সাজিয়ে দেন, যা পাঠে খুবই আগ্রহের সৃষ্টি করে।
সত্তর দশকের বাংলা কবিতার আসরে মুজিবুল হক কবীর অগ্রগণ্য কবি-ব্যক্তিত্ব। অগ্রগণ্য এই জন্য যে, তাঁর কবিতা
জীবনঘনিষ্ঠ চেতনায় পরিপুষ্ট। ভাষা ও যাদুকরী শব্দখেলায় তাঁর কবিতা স্পর্শ করে জীবনশিল্পের স্তর। অতি করুণ ও বিলাপসর্বস্ব
বিষয়কে তিনি সৌন্দর্যময় চিত্রের মঞ্চে উপবিষ্ট করেন। এর মধ্যে তাঁর পরিমিতিবোধ ভিন্ন রকমের ব্যঞ্জনা উপহার দেয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধে বলেছেন, "সৌন্দর্য সৃষ্টি করাও অসংযত কল্পনাবৃত্তির কর্ম নহে।
সমস্ত ঘরে আগুন লাগাইয়া দিয়া কেহ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায় না। একটুকুতেই আগুন হাতের বাহির হইয়া যায় বলিয়াই ঘর
আলো করিতে আগুনের উপরে দখল রাখা চাই।" তিনি একই প্রবন্ধে আরো বলেছেন, "...........
পরিণামে সৌন্দর্য মানুষকে সংযমের দিকে টানিতেছে। মানুষকে সে এমন একটি অমৃত দিতেছে যাহা পান করিয়া মানুষ
ক্ষুধার রূঢ়তাকে দিনে দিনে জয় করিতেছে। অসংযমকে অমঙ্গল বলিয়া পরিত্যাগ করিতে যাহার মনে বিদ্রোহ উপস্থিত হয়
সে তাহাকে অসুন্দর বলিয়া ইচ্ছা করিয়া ত্যাগ করিতে চাহিতেছে।"
রবীন্দ্রনাথের এই অসংযমকে অমঙ্গল বলে কবি মুজিবুল হক কবীর সংযম ত্যাগ করেন না। সংযমের বৃত্তে আবর্তিত হয়ে
তিনি কষ্টাপ্লুত ভাবকে সৌন্দর্যময় চিত্রকল্পের ফোয়ারায় পরিবেশন করেন এভাবে-
".............................
কুয়াশা নেমেছে নদীজলে,
নদী-পাড়ে কাশবন
বুনো প্রাণীর হল্লা
ঝিঁঝিঁর গুঞ্জন
রাতজাগা পাখির ডাক
নদী ঘাটে আসে কোন্জন?
চোখে তার মেঘান্ত-উদাসী ছায়া
চূর্ণচুল এলিয়ে পড়েছে পিঠে,
ধীর পায়ে নামে জলে,
জলের গভীরে
ডুব দ্যায়
ভাসে তাঁত-বোনা যজ্ঞডুমুর-রঙা শাড়ি
সে কি খুঁজে পায়
রূপোলি মাছেদের বাড়ি ?"
(রূপোলি মাছেদের বাড়ি / রাতের শিরায় আগুন)
কবি মুজিবুল হক কবীর তাঁর সমস্ত কাব্যক্ষমতাসমেত নিজেকে লুকিয়ে রাখেন ভয়ঙ্কর খোঁড়লে। পছন্দ করেন নির্জনতা।
কেননা, তিনি যখন বলেন-
"যেদিকে বাড়াই পা
সেদিকেই ক্লেদ,
ধর্ম ও বেদ, ব্রহ্মশব্দ অসার।
আগুনের আঁচ পেয়ে ঈশ্বরও কেঁপে ওঠেন।"
(রাতের শিরায় আগুন / রাতের শিরায় আগুন)
তখন কি করে থাকবেন লোকালয়ে- তাইতো একাকীত্বের আগুনে পোড়ান নিজেকে। তাঁর কাব্যের গহন বনে হৃদয়ে চির ধরা
এক করুণ বাঁশির সুর নির্জনতাকে আরো নির্জন করে। তাঁর কিছু কবিতার বিষয়বস্তু একা, আছে, নাই প্রভৃতি। একার চরিত্রটিতে
সঙ্গীতময় অন্বয় যুক্ত করে কবি কারো অনুপস্থিতির বিলাপ করেন। এই একাকীত্বের হাহাকারের মধ্য দিয়ে কোনো এক অপূর্ব সুন্দরের
কথা বলতে চাইছেন কবি। তিনি বলেন-
"একা।
এমন একার সঙ্গে যেনো হয় না কারোর দেখা,
একা।"
(একা / রাতের শিরায় আগুন)
এইসব ছন্দোবদ্ধ কবিতার আলপথে কবি অনুভব করেন একধরনের শূন্যতা ও অস্তিত্বের সংকট। এই শূন্যতা ও অস্তিত্বের সংকট
সনাক্ত করতে না পারার কারণে দগ্ধ হন তিনি-
"কি যেন কি নেই একলা একার বুকে
কি যেন কি নেই একা থাকার সুখে"
(একা / রাতের শিরায় আগুন)
আবার কাঙ্ক্ষিত মানবী কিংবা এরকম কোনো কিছুর আগমন টের পান তিনি। সেই কারণে তাঁর ভেতর নবজীবন লাভের একটি
প্রত্যাশার জন্ম হয়। তিনিও স্বপ্ন দেখেন এই প্রত্যাশার হাত ধরে বিপর্যয়কে পরাভূত করতে-
"কাকে বলবো একা ?
একার সাথে নিত্যদিনই একারই হয় দেখা,
একা।"
(একা / রাতের শিরায় আগুন)
এবং
"একটি মানবিক হাত স্বপ্নময়। ছাত ফুঁড়ে
উঠে আসে একা
মৌন আকাশের দিকে,"
(বিশাল বাড়ির ফটক / রাতের শিরায় আগুন)
মুজিবুল হক কবীরের কাব্যজীবনের শুরু সত্তর দশকের ঊষালগ্নে। ষাটের দশকের উত্তাল গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনের
পর অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন দেশের পথ চলা। মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির
ভেতরে সত্তর দশকের কবিদের কাব্যযাত্রা। মুজিবুল হক কবীরের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের খড়া সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়লেও তাঁর কবিজীবন বিলীন
হয়েছে তাঁর কবিসত্তার কাছে। তিনি চারপাশের উপলব্ধিকে সময়ের গণ্ডীতে নয়, সর্বকালীন ও সর্বজনীন কাব্যসৌন্দর্যে নতুন এক কাব্যজগত
তৈরিতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। এ ব্যস্ততা তাঁর হৃদয়সঞ্জাত উপলব্ধির ফোয়ারা।
কবি মুজিবুল হক কবীরের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছয়। সংখ্যার বিচারে নয় গুণগত বিচারে তাঁর কবিতা এক বিশিষ্টতা পেয়েছে। 'পা যে আমার
অনড় পাথর' (১৯৮৭), 'লোপামুদ্রা ও অন্যান্য কবিতা' (১৯৯১) ও 'আমি ও আমার প্রতিবিম্ব' (২০০০) এর পর এ তিনটি
গ্রন্থের বাছাই কবিতা ও নতুন কিছু কবিতা নিয়ে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'রাতের শিরায় আগুন' (২০০১)। তাঁর পরের দু'টি কাব্যগ্রন্থ হলো
'জলের অদ্ভুত সংগীত' (২০১০) এবং 'অগ্নিগর্ভ দিন' (২০১১)।
কাব্যসিঁড়ির ধাপে ধাপে সৌন্দর্যের দ্যোতনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঋদ্ধ কবি মুজিবুল হক কবীর জলসঙ্গীতের উঠানে নিজেকে একাত্ম করেন। তাঁর
'জলের অদ্ভুত সংগীত' (২০১০) কাব্যগ্রন্থে জলের তিন স্তরে ভ্রমণ করেন অবলীলা ভঙ্গিতে। সমাজসিঁড়ির ধাপে ধাপে তাঁর ব্যাকুল হৃদয়
আকুল হয় বরফের দেশে, ঘাসের শিশিরে, মেঘের ডানায়। মানবজীবনের আদিলগ্ন বরফযুগের সঙ্গে মানুষের অদৃশ্য সুতোর টান আজও
উপস্থিত। মানুষ কেন, প্রাণের সূত্রপাতও জলে, শুধু জলে। পৃথিবীর উপরিভাগে বরফের রাজ্য থাকলেও একসময় উষ্ণতাও অনিবার্য হয়ে
দেখা দেয়। উষ্ণতা আর বরফ এ যেন এক খেলা। জন্ম বরফের দেশে- বিস্তার উষ্ণতায়। বরফ যেন অদৃশ্য প্রাণের টান আর উষ্ণতা বাস্তবতা-
"বরফ ভাসে জলে, হৃদয় ভাসে জলে, পাখিদের স্বপ্ন, নীড়,
ডিম, শিশুপ্রাণ জলে ভাসে; ভাসতে ভাসতে জলপ্রিয়
পাখিদের ঘর-গেরস্থালি ভেসে যায়; মানুষের মাথায়
বরফ মুকুট- বরফযুগ পেরিয়ে এসেও মানুষ বরফ-স্বপ্নে
বিভোর, তুষার ও জলশীতে কাতর; তবু মানুষ ছোটে
জলমেঘলাবৃত বরফের দিকে, ..............................."
(শীতের পঙক্তিমালা/জলের অদ্ভুত সংগীত)
বরফ, তুষার আর জলশীতে সবাই আজ কাতর, কার না মন চায় উষ্ণতা পেতে। এ যেন সভ্যতার অগ্রসরমান সংকেত। শুধু কি তাই,
এ সমাজ সংসার রাজনীতির যাঁতাকলে সমতা রক্ষায় সচেতন? তা যদি হবে তাহলে কবি কেন লিখেন-
"ওম পেতে কার না সাধ জাগে? পৃথিবীর ভাসমান মানুষদের
কোন ওম নেই- ঘুম নেই- কিচ্ছু নেই- আছে শুধু জোড়াতালি-দেয়া
একখানি ছোট্ট আকাশ।"
(প্রাগুক্ত)
কবি মুজিবুল হক কবীরের কবিতায় মিথের ব্যবহার বাহুবল সাহায্য বিবর্জিত। বলা যায়, অনিবার্যভাবে মিথের প্রকাশ তাঁর কবিতায় অকঠিন,
যোগাযোগ অন্বয়ী। তাঁর কবিতায় মিথের ব্যবহার কৌষ্ঠকাঠিণ্যে দুর্বোধ্য করে না বরং ভঙ্গিমার বাঁকে বাঁকে থাকে থাকে সাজানো মিথ কবিতার অর্থ ও
ব্যঞ্জনার দ্যুতি প্রকাশে পাঠককে শিহরিত করে, আকর্ষণ করে। সাহিত্যে মিথ এমন একটি শক্তিশালী উপাদান, যা ইতিহাস, সমাজভাবনা,
সনাতন ধর্মীয় চেতনা উৎসারিত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ শুধু নয়, মিথ সমাজ জীবনের গহনপথে প্রতিনিয়ত জন্মলাভ করে। সফল কবিতা বা কবিতার
কোন অংশ কালের বিচারে মিথরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কবি মুজিবুল হক কবীরের কবিতা মিথ ব্যবহারে ঋদ্ধ হয়েছে এভাবে-
"জল নেই, নুন শুধু অই কটা চোখে
মাংসও বিস্বাদ ঠেকে, বিমবিষা জাগে;
সহসা চেতনা জুড়ে দাঁড়ায় চন্দ্রানী
অনার্য কুমারী মেয়ে প্রেম-ভিক্ষা মাগে।"
(বিষ্ণু দে/রাতের শিরায় আগুন)
"ব্রহ্মার হৃদয়-কোরকের ছোট্ট কোষে সোনালি মৌমাছি
আলোর অধিক হাহাকার তোমার চৈতন্যে;
ব্রহ্মশব্দচূর্ণ তুমি কিংবা শব্দঝিনুকের
অভ্যন্তরে বসা বোধিবৃক্ষ, ..... "
(তোমার প্রপাত ধ্বনি/রাতের শিরায় আগুন)
"কিংবা মানুষ নদীর ভাষা? উৎস কোথায় একটি নদীর?
শিবের জটায় বন্দি-থাকা গঙ্গামাতা
মুক্ত হয়ে স্বমহিমায় বইতে থাকে।"
(নদীপুরাণ/জলের অদ্ভুত সংগীত)
"পাতায় পাতায় বাজে উপনিষদের সুর
মধ্যাহ্ন-সূর্যের আঁচ এসে লাগে কবিতায়,
হঠাৎ পঞ্চপাণ্ডব কী এক তাণ্ডবে মাতে"
(কবিতার হৃৎপদ্ম/জলের অদ্ভুত সংগীত)
"হৃদয়মথুরা কেঁপে কেঁপে ওঠে, কোথা থেকে আসে
এমন বিবাগী হাওয়া!"
(বৃষ্টি উত্তরীয়/অগ্নিগর্ভ দিন)
"নিবিড় পঞ্চবটী বনে আধো-ঘুমে, আধো জাগরণে
কাটায় রাত বুনো হাতি"
(হরিৎ বনভূমি/অগ্নিগর্ভ দিন)
"তুমি পুরোহিত যজ্ঞে,
তোমাকে রক্ষা করে, পরিচর্যা করে
অঙ্গিরাগণ প্রবল বর্ষার সমাগমে।"
(অগ্নি/অগ্নিগর্ভ দিন)
প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি কবিতায় কেন মিথের ব্যবহার করেন! এর উত্তর একাধারে কঠিন মনে না হলেও মিথ সম্পর্কে খণ্ডিত জ্ঞান বোধে বাধ
সাধতে পারে। সাধারণত: সমাজ, সভ্যতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের গূঢ়তা অনুসন্ধান করে বর্তমানে কবিতা বা সাহিত্যের প্রাণ সঞ্চারে
সচেষ্ট থাকতে চান কবি বা লেখক। এক্ষেত্রে কবি মুজিবুল হক কবীর একটু আলাদা হিসেবেই উজ্জ্বল। কেননা তিনি মিথশব্দ চয়নের মধ্যদিয়ে
সমকালীন শব্দে যুগলবন্দি করে পুরান-বর্তমানের এমনভাবে সেতুবন্ধন তৈরি করেন যা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় নতুন মিথের জন্মধারণের প্রচেষ্টায়
পরবর্তীকালে উপস্থাপনের প্রস্তাব করে।
কবি মুজিবুল হক কবীর নারীকে তুলে এনেছেন অনন্য সাধারণতায়। একজন কবির কাছে কবিতাই নারী। আবার কবিতার ও নারী শব্দ-রসে
মেতে ওঠে। নারীকে অনন্য এক মর্যাদায় অভিসিক্ত করেন কবি এভাবে-
"কবির কাছে কবিতা- প্রিয়তমা, নাকফুল-দেয়া নববধূ
কিংবা তারও চেয়ে অধিক কিছু।
নারী ও কবিতা
কবিতা ও নারী
শব্দে ও রসে মাতে
যেমন মাতে পাহাড়ের চূড়োয়
যৌবনবতী মহুয়া-মাতাল চাঁদ;"
(নষ্ট ডিমের কুসুম/রাতের শিরায় আগুন)
কিংবা-
"নারী চায় সহজ সঙ্গতা
রসময় রঙ্গতা,
আর, কবি চায় প্রতি অঙ্গ কথা বলুক
কবিতার ভাষায়।"
কিংবা-
"শব্দের ভিতরে শব্দ
ধ্বনির ভিতরে ধ্বনি
নারীর ভিতরে কবিতা
আর কবিতার ভিতরে নারী।"
(কাশ্মিরী রাত/রাতের শিরায় আগুন)
মুজিবুল হক কবীর রাজনীতি ও সমাজ দূরাবর্তী কবি নন, স্বৈরতন্ত্রের তাণ্ডবের বিদ্ধুদ্ধে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে কাব্যযুদ্ধ করেন তন্তুজালে বন্দি
মানুষের পরিত্রাণের এক মায়ামণ্ডল সৃজনের মধ্যদিয়ে। পলল-ঘেরা কাজলা-নারীর জন্যে তিনি সুস্থ সবল রাজনীতি চান, ফোটাতে চান
অঙ্গীকারের জীবনফুলের রক্তকুঁড়ি। 'রাতের শিরায় আগুন' কাব্যগ্রন্থের 'দিচ্ছে নাড়া' কবিতায় তিনি আলোছায়ায় ঘামটিমারা অশুভ পঙ্গুনীতির
শাসকের কালবৃত অবস্থানকে স্বরবৃত্তের শর নিক্ষিপ্ত করে প্রতিবাদে অবতীর্ণ হয়েছেন; বলেছেন, 'এখন আমার বসে থাকার নেই তো সময়/
কাল-বিহঙ্গ, ক্ষমা করো।' একই কাব্যগ্রন্থে 'স্বৈর রজ্জুতে বাঁধা গণতন্ত্র' কবিতা ১৯৯০-এর গণআন্দেলনকে উপলক্ষ করে রচিত। এই
কবিতায় কবির দীর্ঘ বাচনরীতি উপস্তিত। এর শেষাংশ ব্যতীত কবির কোমল হাতের স্পর্শে স্বৈরাচারের স্বৈরনীতি ভুলিয়ে দেয়ার সংকেত দিয়েছেন।
শেষাংশে-
"ওরা যেনো ক্ষমতাদর্পী, পীড়নকারী,
এই দৃশ্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করে লড়ে যেতে,
প্রতিনিয়ত
আমরা লড়ছি, ভেতরে বাইরে
বাইরে ভেতরে।"
সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপথই কোমল থেকে কঠিনে। এখানে হতবাক হতে হয় এই ভেবে যে, 'স্বৈর রজ্জুতে বাঁধা গণতন্ত্র'
কবিতার শরীর সৃষ্টিতে কবি সকল আন্দোলনের গতিবেগকে অনুসরণ করেছেন।
কবি মুজিবুল হক কবীরের কবিতায় সামাজিক টানাপোড়েনের চিত্রও ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে। 'গৈ-গেরামের মাটি ছেড়ে, সবুজ ছেড়ে,
খামার ছেড়ে' তরুণদের জীবনের সলতে পোড়ে ত৭ার কবিতায়। জীবন-সাঁকো পাড়ি দিতে পাল্টে যায় দিন দিন সামাজিক পেশাদারিত্বের
মেল-বন্ধন। যেমন-
"যাচ্ছে পহর, দিনের বহর
মনের ভেতর জমছে শুধু ক্লেদ
মিথ্যে ওসব ধর্মকর্ম, উপনিষদ, বেদ।"
(টানাপোড়েন/রাতের শিরায় আগুন)
তাই-
"এই চৈত্রে তুই নেই, এই বোশেখে তুই নেই।
আকাশে মেঘ-ঐরাবত, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমক;
হঠাৎ মেঘমল্লার রাগে তুমুল বৃষ্টিধারা
বৃষ্টিজলে ডুবে আছে তৃণমূল মানুষ।"
(এই বোশেখে তুই নেই/জলের অদ্ভুত সংগীত)
সেজন্যে-
"এই মনুষ্যবিরল ভূমিতে এখন সন্ধ্যা
না হতেই আসে নেকড়ের দল
লুপ্ত বটের শেকড়বাকড় খুঁজে কি পেয়েছে
ভাঙা মন্দির?"
(স্বপ্নপুরাণ জেগে ওঠে/অগ্নিগর্ভ দিন)
কবি মুজিবুল হক কবীরের প্রথম চারটি গ্রন্থের কবিতায় তাঁর স্বভাব স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্যের বীজ বপন করেছেন। তাঁর কাব্যসাধনা একটি নির্দিষ্ট
পথের ওপর দণ্ডায়মান। তিনি কবিতাকে জীবনঘনিষ্ট চেতনার স্তরে পরিপূর্ণ করার জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর এই স্তরের প্রধানতম দিক
হলো তাঁর কবিতায় যতটুকু আবেগের বহিঃপ্রকাশ, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মননশীলতা। এ পর্বের প্রায় সবগুলো কবিতাই
মননশীলতার প্রতাপে এতোবেশি সুখপাঠ্য যে, মাঝে মধ্যে এসব পাঠান্তে পরম প্রশান্তির যোগান দেয়। সত্তর দশকের কবিদের কবিতার মধ্যে
হাতে গোনা কয়েকজন কবির পাশাপাশি তাঁর কবিতাও এত বেশি মাত্রায় পাঠককে উদ্বেলিত করে যা তাঁর নিটোল সৌন্দর্য ভাবনার চিরায়ত রূপ
বলে মনে হয়।
|