কবি মাহবুব হাসানের অনুভব ও উপলব্ধির চারপাশে জমা হয় মানবিকতা। অমানবিকতার কণ্ঠ চেপে ধরতে মানুষের নিত্যকর্মের
বিচিত্র প্রাঙ্গণ থেকে তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেন অসঙ্গতির অজস্র অনুষঙ্গ। তিনি এ কাজটি করেন অত্যন্ত খুঁতহীন মানবিকতার
ওপর ভর করে। তিনি কাব্যবিষয় প্রকাশে অনায়াস ভঙ্গি, দৃঢ় ও পরিচ্ছন্ন উচ্চারণ পছন্দ করেন। তিনি ভালবাসেন প্রকৃতি ও
মানুষকে, নারী ও ফুলকে, জ্যোৎস্না ও জনমকে, নগর সভ্যতা ও জাগতিকতাকে। এদিক থেকে কবি মাহবুব হাসানকে বিবেকবান
প্রেমিক-কবি বলা যেতে পারে। কেননা, তিনি প্রেমের পেলব অনুভূতির ওপর ভর করেই সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে
ওঠেন-
"ঠিক মানুষের মতো দেখতে কিন্তু মানুষ নয়
গায়ে সজারুর কাঁটা
আর আছে শিং মাথার মগজে!
... ... ...
... ... ... ...
ক্বচিৎ কখনো এই শিং জাতি আর্ত-মানবতার সেবার নামে
দেশের আনাচে কানাচে ঢুকিয়ে দেয়
সুশৃঙ্খল নিজস্ব বাহিনী,"
(ঠিক মানুষের মতো দেখতে কিন্তু মানুষ নয় / তোমার প্রতীক)
বৈশ্বিক অসঙ্গতির বিষয়ও কবি মাহবুব হাসানের চোখ এড়ায় নি। যখন দেখেন এরকম মানবিকতার নামে অমানবিক কার্যসিদ্ধি হয়
উদ্দেশ্য, তখন তিনি দ্রোহ করেন। এ দ্রোহ 'জ্বালাও পোড়াও' পথে নয়। মানুষের চিত্তকে স্বাধীন ও সচেতন করে তোলার
ভাষা তিনি ব্যবহার করেন কবিতায়।
আপাতদৃষ্টে তাঁর কবিতার ভাষা-ভঙ্গি জটিল নয়, যে কোনো পাঠকই তাঁর কবিতার স্রোতাভিমুখ ধরতে সক্ষম। কিন্তু এ স্রোতের
গভীরে আরেক স্রোত তাঁর কবিতায় ঘূর্ণায়মান থাকে, যা পাঠক-সমালোচকের অনুমানভিত্তিক চেষ্টার মাধ্যমে এক জটিলতার জাল
ছিন্ন করতে হয়। কখনও কখনও পাঠক বিভ্রান্তিতেও নিমজ্জিত হতে পারেন। জটিল ভাষ্যে নির্মিত নয় অথচ গভীর, এমন কবিতায় চিত্রকল্পের
মধ্যে তিনি এক প্রকার কম্পন ব্যবহার করেন। 'তোমার প্রতীক' কাব্যগ্রন্থের 'হৃদয়হরণ মাছেদের কথা' কবিতায় এ ধরনের চিত্রকল্প
নির্মাণ করেছেন তিনি-
"জলের ওপরে শাদা টোন কাঁপে
কেঁপে উঠি আমি
মনে হয় মাছের ঠোকর; কিন্তু না, পরক্ষণেই
নিরাক জলের ওপর শাদা ভাসমান টোনটিকে দেখি স্থির, ভাসমান;
একটুও কাঁপন নেই তাতে।
অথচ মনের গহীন জলে টলে ওঠে মানবিক টোন
সুগন্ধি খাদ্যের ভারে নত বড়শীর ঠোঁটে
শতাব্দীর মাংসাশী লোভ ঝুলে থাকে।"
এ রকম কবিতায় অমানবিকতার স্তর থেকে উঠে আসা একধরনের লোভ চিত্রটিকে শাসিয়ে দেয় কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে
চায়। বস্তুত: এ ধরনের লোভ ইতিবাচক প্রক্রিয়াকে শাসন করতে চায় এবং তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জন্ম দেয়
নির্লজ্জ সমীকরণ।
কবি মাহবুব হাসান সাম্প্রতিককালেও দ্রোহসিঁড়িতে অবস্থান করছেন; তবে তা দেড়যুগ আগের মতন নয়। কবিগণ নিয়মিত
তাঁর কবিতাকে ছাড়িয়ে যান নতুন কবিতার দিকে। বাঁক নেন নব-লব্ধ অভিজ্ঞতার স্টেশন অভিমুখে। তিনি সম্ভবত এ থেকে
কিছুটা ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে তিনি চেতনাগত বাঁক নেন নি, বাঁক নিয়েছেন উপস্থাপন ঢঙে। কেননা তিনি কবিতার জমি
চষতে এসেছেন চেতনাগত পূর্ণতা নিয়ে। আসলে কবিকে একই ভাষাপথ কিংবা শব্দানুষঙ্গ ব্যবহারে ডগমেটিক হল চলে না।
কবিতার অঙ্গে ভাষা কিংবা শব্দ প্রতিনিয়ত বদ্লে যাওয়ার হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে হয়। এমন হাওয়া-বদলে কবির ক্লান্তি থাকতে
নেই, হারও মানতে নেই। ভাষা ও শব্দের সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে প্রকাশের মেজাজও যায় পাল্টে। তবে এভাবে খেলতে গিয়ে ঝাঁঝালো
শব্দের গন্ধ কবিতাকে শাসিয়ে দেয়। তাই শব্দের শাসানো কবিতা নয়, প্রয়োজন শব্দের নবীন ব্যবহারের মধ্যেদিয়ে প্রকৃত কবিতা,
যা উপহার দেয় ব্যঞ্জনা। কিন্তু এতো শাসন কী মানা যায়! জীবনের কথা বলতে গিয়ে কবিও হয়ে পড়েন কখনো শক্ত পাথরের মতো
আবার কখনো নিবিড় তন্ময়তায় সমর্পণ করেন নিজকে। কবি মাহবুব হাসান যখন লিখেন-
"একবার জেগে উঠি মৃত্যু সাগরের অতল আঁধার থেকে
একবার ঘুমিয়ে পড়ি রৌদ্রময় দখিনা বাতাসে অসীম স্বপ্নের ঘোরে
এই খেলা
নিয়তির
এই চক্র
নিয়তির
এই বিধি
নিয়তির!
আমি নিসর্গ নিয়মে জাগি, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে বাঁচি
আমি স্বপ্নের আধার থেকে দুঃস্বপ্নের আধারে যেন
পিং পং ক্রীড়নক
এক মানুষ!
(এক দুই তিন : ২ / তিনি কথক ছিলেন)
তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না কবি আহসান হাবীবের ছায়াসমৃদ্ধ এই কবিতার আর্তিযাত্রা অন্ধকার বিদীর্ণ করার মহৎ
উদ্দেশ্যের পথে।
আবার শব্দের খেলা খেলতে খেলতে, খেলাচ্ছলে নতজানু হতে হতে দ্রোহ করেন তিনি মায়াময় কৌশলে। আকালে মানুষ
কি খায় নি- তীব্র সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে কবি মাহবুব হাসান অতি সাধারণ পরিচিত শব্দ ব্যবহার করে
শব্দের এক অসাধারণ খেলা করেছেন। এ রকম কবিতা পাঠে পাঠকের গভীর চৈতন্য থেকে উৎসারিত হয় প্রতিবাদের দ্যুতিময়
স্পন্দন এবং বেঁচে থাকার সুতীব্র বাসনা-
"বাঁশের কোরল খেতে দেখিনি কখনো
পাখির বাসার ভাজি না-কি স্বাদু খুব?
শুনেছি এ জাদুই খবর!
আকালে মানুষ খায়নি এমন খাবার পৃথিবীতে আছে?
মানুষ স্বপ্নের জাল বোনে, স্বপ্ন বিক্রি করে খায় পৃথিবীর
তার নীবীডোর নেই, উদোম প্রকৃতি কেবল জাদুবাস্তবে খেলা করে!
(এক দুই তিন : ৩ / তিনি কথক ছিলেন)
মাহবুব হাসানের কবিতা কখনো এগোয় ছন্দের মসৃণ পথ বেয়ে। মসৃণ পথের কোথাও কণ্টক থাকলে তা পায়ে বেঁধে। বিরক্তির
উদ্রেক করে। কবিতায় ছন্দের কাল আমরা পেরিয়ে এসেছি বহুদূর- এই কথা বলে অনেকেই এ কণ্টককে সুন্দরী রমণীর কপোলে
তিলের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। আবার অনেকেই এ সৌন্দর্যের বদলে 'ফিজিওলজিক্যাল প্রবলেম' হিসেবে দেখতে
চাইলে তাও ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া যাবে না। মোদ্দা কথা, ছন্দে কবিতা লিখলে তা সিদ্ধরূপে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, তা হোক না
গদ্যের ঢঙে। যদিও ছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কবিতার রস ক্ষুণ্ন হোক এটা কেউ চাইবেন না। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে লিখেছেন
"ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে; ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় আনুষঙ্গিক হয়ে।" এতে
পরিষ্কার হয় যে, ছন্দে কবিতা লিখতে গেলে কবিকে এ দুইয়ের দিকেই সমান দৃষ্টি দিতে হয়। মাহবুব হাসানের অষ্টম কাব্যগ্রন্থ
'তোমার অহনা'র প্রথম কবিতা 'তুমি তো মা আমার' মাত্রাবৃত্তের সাত মাত্রার চালে লেখা। মাত্রাবৃত্তে কবিতা লেখা হয় অসংখ্য,
কিন্তু মাত্রাবৃত্তের সাত মাত্রার চালে অন্য যে কোনো ছন্দের চালের তুলনায় লেখা হয় খুব কম। তথাপি কবি মাহবুব হাসান যখন
লেখেন, "তুমি তো মা আমার,/মাতৃ-মণ্ডলি গাঁ ও গঞ্জেরও/শেকড় গাঁড়া আছে পেলব পল্লীর প্রত্ন-চেতনায়/তুমি তো তাদেরই
মাতৃ নও শুধু/.........../চিনিয়ে দিয়েছো ঐ গাঁয়ের পথঘাট, মানুষ-প্রাণীদের বিশাল নীলাকাশ!/........../এঁকেছো
বীরবাহু মুক্তিযোদ্ধার নগ্ন গা-গতর এবং সাহসও"; তখন সুন্দরী নারীর কপোলে সৌন্দর্যের তিলটির আকার খুব বড় হয়ে পড়ে
না কী! রবীন্দ্রনাথ 'কাব্য ও ছন্দ' প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, "ছন্দের একটা সুবিধা এই যে, ছন্দের স্বতই একটা মাধুর্য
আছে; আর কিছু না হয় তো সেটাই একটা লাভ। সস্তা সন্দেশে ছানার অংশ নগণ্য হতে পারে কিন্তু অন্তত চিনিটা পাওয়া যায়।
কিন্তু সহজে সন্তুষ্ট নয় এমন একগুঁয়ে মানুষ আছে, যারা চিনি দিয়ে আপনাকে ভোলাতে লজ্জা পায়। মন-ভোলানো মালমসলা বাদ
দিয়েও কেবলমাত্র খাঁটি মাল দিয়েই তারা জিতবে, এমনতরো তাদের জিদ। তারা এই কথাই বলতে চায় আসল কাব্য জিনিসটা একান্তভাবে
ছন্দ-অছন্দ নিয়ে নয়, তার গৌরব তার আন্তরিক সার্থকতায়।"
কবি মাহবুব হাসান রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের অনুসরণে কবিতা লেখেন কথাটি সত্য, তিনি আরো একটু এগিয়ে যদি ধরে নেন,
কপোলের তিল যদি তাল হয় তবু তার রস বলে কথা। তবে ওখানেই তাঁর জিদ।
কবি মাহবুব হাসান নিজেকে 'কোথাও একা' বলে ঘোষণা করেন। 'চলেছি কোথাও একা' শব্দত্রয়ের দ্বারা তিনি বহুধাবিভক্ত বিষয়কে
একীভূত করে একই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। অসহায় কিংবা অভিমান কিংবা অনন্তযাত্রা হিসেবে একই ক্যানভাসে একাকীত্বকে মূর্ত করে
তুলেছেন 'একাকী ভ্রমণ' কবিতায়। এই একাকী যাত্রার গন্তব্য যদি হয় মৃত্যু উপত্যকা, তবে জন্মগ্রহণের সমার্থক হয়ে ওঠে তা।
কেননা, মানুষ আসে একা, যায় একা। এই একাকীত্ব নড়াচড়া থেকে হিম হওয়া পর্যন্ত সমগ্র জীবনের উপলব্ধিতেও কোনো ব্যতিক্রম থাকে
না। কবি মাহবুব হাসানের কবিতা পড়তে পড়তে কোনো কোনো কবিতায় চক্ষু স্থির হয়ে যায়। এমনি একটি কবিতা 'একাকী ভ্রমণ'।
'আমার আকাশ' কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ এই কবিতায় তিনি জীবনের চলার পথে একাকীত্ব অনুভবকে আলাদা ব্যঞ্জনা উপহার দিয়েছেন।
কবি মাহবুব হাসানের কবিতার আসল ঐশ্বর্য হচ্ছে মানুষের জীবন এবং জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত উপশমের নিরন্তর প্রচেষ্টা। অত্যন্ত
সাবলীল ভাষায় অকপট দরদী মনের নিবিড়তায় পুষ্ট তাঁর কবিতায় পাই এক ধরনের মায়ামন্ত্র। যে মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে পাঠকের
সর্বকাল।
"চলেছি কোথাও একা
ধূসর অচেনা পথঘাট
সুদূরে কোথাও
ট্রেনে না জলযানে
ঢোকে না মগজে
শুধু শুনি বাঁশি
ক্যু ক্যু ক্যু
টানা গদ্যের মতন"
'একাকী ভ্রমণ' কবিতার শুরুতে এ যাত্রা অচেনালোকের যাত্রা, অনন্তলোকের যাত্রা। তিনি শুধু বাঁশি শুনতে পান ক্যু ক্যু
ক্যু। একই কবিতায় তিনি আবার বলেছেন-
"কখনো পাহাড়ি হাতি
বেঁতো ঘোড়া
গাধা কিংবা খচ্চরে
খোঁড়া ভিখিরির মতো গেছি
দ্বারে দ্বারে"
কবিতাটিতে কবি পার্থিব ও অপার্থিবের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের এক চমৎকার চিত্র এঁকেছেন। অচেনালোক অর্থাৎ মৃত্যুলোক চরম
সত্য। এটা পরিহার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অথচ এটা ভুলেই বসে থাকে অধিকাংশ মানুষ। কারণ, আদিম প্রবৃত্তি ও
সমাজের শৃঙ্খলের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ এ সত্যকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু দূরে সরিয়ে রাখার আকুলতা
যখন ব্যর্থতায় রূপ নেয়, তখন মানুষ পরম মমতায়, স্নেহে, চরম চেষ্টায় মর্ত্যলোকের সম্পর্কটি ধরে রাখতে চায়, সঙ্গী করতে চায়।
এই পার্থিব ও অপার্থিব সম্পর্কে এক দার্শনিকবোধ সৃষ্টি হয় মানুষের মধ্যে। 'একাকী ভ্রমণ' কবিতায় কবি মাহবুব হাসান এই
বোধটিকেই প্রকাশ করেছেন বাস্তবতার নিরিখে। কবিতাটির শেষে তিনি উল্লেখ করেছেন-
"শিকল-পরা ক্লান্ত মানুষ
নিরন্তর একা।"
এই শিকল পরিয়েছে কে? মানুষের পায়ে আদিম মানব-প্রবৃত্তি নাকি অনন্তলোক অধিকর্তা। আদিম-প্রবৃত্তি পরালে তা অসহায়তায়
মূর্ত। আবার অনন্তলোক অধিকর্তা পরালে তা শাশ্বত সৃষ্টির মহানিয়ম। এ দু'য়ের উপলব্ধি একই সঙ্গে একই পঙক্তিতে প্রকাশ এক অনবদ্য
সৃষ্টি।
|