কবি বিমল গুহ'র ভালবাসা : অন্তর-বাহির

সুমন সরদার

      "আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না

      বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়,

      বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না

      প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়,"

                 (আলোক বর্তিকা / অহংকার, তোমার শব্দ)

এরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে কবি বিমল গুহ কাব্যচর্চায় নিমগ্ন। মানুষের শাশ্বত অনুষঙ্গের ওপর ভর করে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর অহংকার। এ অহংকার পতনের বিপরীতে জীবনের জয়গান, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা। যে ভালবাসার উত্তাপে ছাই হতে থাকে জোছনাপোড়ানো লোলুপগ্রস্ত অগ্নি-উৎসমুখ। যে ভালবাসা বিষাদগ্রস্ত মানুষের হাতে তুলে দিতে থাকে রক্তকণিকায় স্পন্দনযোগানো জ্বলন্ত-মশাল। এমনকি যে ভালবাসা 'চাঁদ ও সূর্যের মতো পরস্পর নৈকট্য নিয়ে' আলোক-শব্দ পরম্পরায় জন্ম দিতে থাকে আরেক পৃথিবী। তাই বলা যায় নির্দ্বিধায়, কবি বিমল গুহ যে ভালবাসার কথা বলেন তা নারীরূপে বিবিধ প্রতীক কিংবা পৃথিবী, জীবন, প্রকৃতি প্রভৃতির সৌন্দর্যের স্বরূপ সন্ধানে পরিব্যপ্ত-

      "একদিন সবটুকু ম্লান শব্দ

      বাক্যের বন্ধনে এসে উচ্চারিত হলো ভালোবাসা

      যেন আরেকটি পৃথিবীর জন্ম নিলো,

      চাঁদ ও সূর্যের মতো পরস্পর নৈকট্য নিয়ে

      আমাদের ভালোবাসা স্থির পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে।"

                 (তুমি / অহংকার, তোমার শব্দ)

কিন্তু এখানেই বিমল গুহ'র ভালবাসা স্থির নয়। নারীর প্রতি ভালবাসা যা সরাসরি সেখানেও তিনি রুচির পরিচয় দেন। তা কি ভুল করে, নাকি সচেতনভাবে! সন্দেহপ্রবণবোধ জাগ্রত হয় কেন? তিনি স্বর্ণলতার উস্‌কো-খুস্‌কো চুল পেলেন কোথায়? কোনো পাতা কিংবা উস্‌কো-খুস্‌কো চুলের মতো কিছুইতো এতে নেই। তাহলে এই স্বর্ণলতা কি সাধারণ কিছু নয়, অসাধারণ কেউ-

      "যাচ্ছো কোথা স্বর্ণলতা উসকো-খুসকো চুল

      লতার মতোই হাঁটছো বেয়ে ডানের বৃক্ষমূল

      দাঁড়াও ক্ষণেক গাছের সাথে এলোপাথার ঘিরে

      এইতো ভালো দেখছি আমি-লতার মতো কী রে!"

                 (প্রলম্ব / অহংকার, তোমার শব্দ)

কবি বিমল গুহ'র ভালবাসা সৌন্দর্যবোধের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। নারীর ঠিকানায় তিনি মেখেছেন সৌন্দর্যের এক মোলায়েম-প্রলেপ। স্বর্ণলতা কি আসলেই স্বর্ণলতা! প্রকৃতপক্ষে এ চির সৌন্দর্যময় নারী এবং বৃক্ষ-পুরুষের মূলে এলোপাথারি জড়িয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন শাশ্বত সৌন্দর্য। এ নারীর অহংকার, এ পুরুষের অহংকার। যেন কাল-বৃক্ষে জড়িয়ে এলোপাথারি কর্মযজ্ঞ-স্বর্ণলতা। যেন মানুষের বিরুদ্ধে সকল নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানব-বৃক্ষের মূলে জড়িয়ে থাকার ইতিবাচক নিঃশর্ত-পুষ্পবর্ষণ।

নারীকে ঘিরে কবি বিমল গুহ কঠোর সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। নারীকে দেখেছেন তিনি সৃষ্টির কালজয়ী অনিবার্য উপাদান হিসেবে। সে জন্যেই তাঁর কবিতায় নারীকেন্দ্রিক সৌন্দর্যের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধে লিখেছেনজ্জ "অতএব কেবলমাত্র নিয়ম পালন করাটাকে যদি লোভের জিনিস করিয়া তোলা যায়, তবে কঠোরতার চাপ কেবলই বাড়াইয়া তুলিয়া স্বভাব হইতে সৌন্দর্যবোধকে একেবারে পিষিয়া বাহির করা যাইতে পারে, সন্দেহ নাই। কিন্তু পূর্ণতালাভের প্রতিই লক্ষ রাখিয়া সংযমচর্চাকেও যদি ঠিকমতো সংযম করিয়া রাখিতে পারি তবে মনুষ্যত্বের কোনো উপাদানই আঘাত পায় না, বরঞ্চ পরিপুষ্ট হইয়া উঠে।"

কবি বিমল গুহ রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির পায়ে হাত পেতে বসে থাকেন। তবে কি সর্বসময়? ব্যতিক্রম কিছু কি নেই? তিনি যখন ব

      "তুমি চোখ বুজলেই সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস হবেলেন-

     ... ... ... ... ... ... ...  ... ... ...

      তুমি চোখ বুজলেই গাছপালা বাড়বে না আর

     ... ... ... ... ... ... ...  ... ... ...

      তুমি চোখ বুজলেই মন্দিরের ঘণ্টা আর বাজাবে না কেউ

                 জ্বলবে না দ্বীপ

      মানুষে-জন্তুতে হবে গলাগলি, লোকালয়ে হানা দেবে

      পাগলা মহিষ-বাঁকা শিঙে গেঁথে নেবে

      প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসা-চুম্বনের যমজ উল্লাস।


      তুমি চোখ বুজলেই হৃদকম্পে দুলবে পৃথিবী অহর্নিশ।"

                 (তুমি চোখ বুজলেই / অহংকার, তোমার শব্দ)

এই 'তুমি' যদি 'নারী' হয় তবে তার অনুপস্থিতির কারণে লাগামহীন বিপর্যয় হবে প্রকৃতির, পৃথিবীর। সৃষ্টি-আধারের সমকক্ষ এ নারী চরিত্রটিতে অসংযমি মনোভাব যুক্ত করেছেন তিনি- ভাবলে কি অত্যুক্তি হবে? রবীন্দ্রনাথ 'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধে যখন বলেন, "মানুষের দেখা অংশের মধ্যে যে-সকল বৈপরীত্য প্রকাশ পায় মানুষের না-দেখা অংশের মধ্যেই নিশ্চয় তাহার একটা নিগূঢ় সমন্বয় আছে; অতএব আসল সত্যটা যে প্রত্যক্ষের উপরেই ভাসিয়া বেড়াইতেছে তাহা নহে, অপ্রত্যক্ষের মধ্যেই ডুবিয়া আছে; এইজন্যই তাহাকে লইয়া এত তর্ক, এত দলাদলি এবং এইজন্যই একই ইতিহাসকে দুই বিরুদ্ধ পক্ষে ওকালতনামা দিয়া থাকে।"

রবীন্দ্রনাথের এ উক্তির ধারাবাহিকতায় নিশ্চয় এও বলা যায়, বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু নিজস্ব ভাব লুকায়িত থাকে যা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্যের সৃষ্টি হয় এবং কোনো উক্তির ভেতর এমন কিছু ভাব উহ্য থাকে যা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তার মর্ম উদ্ধারকর্মে সংঘর্ষ বাধে।

উপরে বর্ণিত কবিতাংশের নারী চরিত্রটিকে সৃষ্টি-আধার সমকক্ষ করার যেমন যথেষ্ট কারণ নিহিত আছে, তেমনি এ মত বর্জন করার যুক্তিও উপস্থিত। 'তুমি চোখ বুজলেই' অর্থাৎ নারীর অনুপস্থিতিতে মানবজন্ম থমকে যাবে। পৃথিবীও হয়ে পড়বে ভারসাম্যহীন। কিংবা এই নারী যদি হয় কবি বিমল গুহ'র প্রেয়সী তবে তাঁর জীবনকে ঘিরে রাখা সকল প্রাকৃতিক উপাদান হবে অর্থহীন। অর্থাৎ তাঁর নিজের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়বে। যদি সৌন্দর্যবোধতত্ত্বকে তাঁর কাব্যে শায়িত করা যায়, তবে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটিও প্রাণ ফিরে পায়। এ থেকে স্পষ্ট যে, কবি বিমল গুহ'র ভালবাসা একই সঙ্গে সংযমী, তা সংযমবৃত্তিকদের কাছে এবং একই সঙ্গে অসংযমী, তা অসংযমীদের হাতে।

কবি বিমল গুহ ভোগবাদী ভালবাসা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন কিনা তা বিবেচনায় না এনেই বলা যায় তিনি ভোগবাদিতায় নিমজ্জমান নন। তাঁর মার্জিত ভালবাসার গহীন মন রুচিশুভ্রতায় পরিপূর্ণ। তিনি ভোগবাদী কামনার জাল ছিন্ন করে ভালবাসাকে মুক্তির স্বতোৎপ্লাবনে ভরিয়ে দেন।

            "যেনো তুমি অনেকদিন পর খুলে দিলে ঘরের দরজা।


      সারাদিন পরিভ্রমণের পর

      ক্লান্ত শরীর দখিনের হাওয়ায় বেজে উঠলো রিমঝিম,

      কোথায় ছিলে এতোদিন?

      আশ্বিন কার্তিক গেলো

      অগ্রায়ণ গেলো

      চৈত্রের দরজায় এসে

                 আলুথালু কড়া নাড়লে তুমি!

      ... ... ... ... ... ...  ... ... ... ...

      তুমি চলে গেলে

      খোলা দরজায় বইতে লাগলো এলোমেলো হাওয়া।"

                              (সঙ্গতি / ভালোবাসার কবিতা)

এবং

      "তোমার ওভাবে শুয়ে থাকার মধ্যে

      ঘরময় পুলক শুয়ে আছে।

      ... ... ... ... ... ...

      কাল রাতে

      তুমি এক নতুন ভঙ্গিতে উঠে এলে আমার খাতায়,

      তোমার ওভাবে শুয়ে থাকার মধ্যে শিল্পের প্রচ্ছায়া শুয়ে আছে।"

                              (সহবাস/ভালোবাসার কবিতা)

ভালবাসার দু'টি পর্ব, পূর্বরাগ ও মিলন। কবি বিমল গুহ পূর্বরাগের ক্ষেত্র তৈরিতেই ব্যস্ত। দ্বিতীয় পর্বে পদচারণা তাঁর ভালবাসাকে পাল্টে দিতে পারে এমন করুণ আশঙ্কা তাঁর থাকতেই পারে। শরীরবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তিনি ভীত না হয়ে পারেন না। কবি বিমল গুহ আশ্বিনে, কার্তিকে কিংবা অগ্রহায়ণে 'সঙ্গতি' কবিতায় তুলে আনেন নি প্রেয়সীকে। এনেছেন তাঁর চৈত্রদিনের খরায়। কাব্যে ভালবাসার মিলনভীতিতে জরাজীর্ণ তিনি পালিয়ে বেড়ান চৈত্রদিনে। অন্যদিক বিবেচনা করলে তাঁর যৌবনে প্রেয়সীর আবির্ভাব ঘটে নি, ঘটেছে যৌবনভাটার খরার দিনে। ভালবাসায় এক ধরনের বিষাদ উপস্থিত করেছেন তিনি নিপুণতায়।

'সহবাস' কবিতায় প্রেয়সীর নিপুণ ভঙ্গিতে শুয়ে থাকার ভেতরে শিল্পের প্রচ্ছায়া দেখতে পেয়েছেন কবি বিমল গুহ। ভালবাসার কবিতায় যে মোহাবিষ্ট উচ্ছ্বাস থাকার কথা কবি বিমল গুহ'র প্রায় সব কবিতায় তা অনুপস্থিত। তিনি তাঁর ভালবাসার কবিতায় প্রেম-মিলনের পূর্বরাগের ক্ষেত্রপ্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত থেকেছেন এবং এতেই তিনি রচনা করেছেন অন্যরকম শৈল্পিক প্রতিচ্ছবি। অন্যভাবে বলা যায়, কবি বিমল গুহ যৌবনের উদ্দামতাকে চিরাচরিত গতিমুখের পাশাপাশি অন্যকোনো ইতিবাচক পথে ঘুরিয়ে দিতে চান। এতে উচ্চারিত হয় অনুভবের সততা। তিনি কামনা বা সম্ভোগের চূড়ান্ত যাত্রী না হয়ে শিল্পসম্মত মানবিকতার আবহমানতায় লীন হতে চেয়েছেন।

পঞ্চাশপূর্ণ একজন কবির কাছে শিল্পের প্রত্যাশাও সম্ভবত এটাই। জন্মদিনকে ঘিরেও তাঁর ভালবাসার কমতি নেই। এ ভালবাসা তাঁর ফেলে আসা দিনের প্রতি এক গভীর মমত্ববোধ এবং সময় বয়ে যাওয়ার বিষাদগ্রস্ততা।

      "ফিরে আসে জন্মদিন

      অতীত তাকায় ঘুরে আড়চোখে

      মানুষের দিকে। এইসব কৃতকর্ম দেখে

      কুয়াশায় ভিজে যায় চোখ।

      ক্লান্তি ও ঘামে

      অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে জন্মদিনের উৎসব

                              অবোধ সন্ধ্যায়।

      চতুর বালক করাঙ্গুলে

      আগামী উৎসবের দিন গোণে।"

কাব্য যদি হয় জীবনের আরশি তাহলে এতে অতীত বর্তমানকে জটিল কিংবা উজ্জ্বল করে তুলতেই পারে; এমনকি ভেংচি কাটতেও পারে। কবি বিমল গুহ'র কাব্যগ্রন্থ 'প্রতিবাদী শব্দের মিছিল'-এর অন্তর্গত 'জন্মদিন' কবিতাটিতে জীবনের প্রতি অতীত বহুমাত্রিক ধারায় আলো-আঁধার ছুঁড়ে দিচ্ছে। প্রতি বছরই মানুষের জীবনে জন্মদিন ফিরে আসে। ফেলে আসা দিনগুলো হয় অতীত। কিন্তু এই অতীতও বর্তমান-বিচ্ছিন্ন নয়; বর্তমানকে আড়চোখে দেখে, বর্তমানে ঘোরাফিরা করে, অভিজ্ঞ করে। এমনকি দাঁত বের করে হিহি রবে হেসেও ওঠে। অতীতের জ্যান্ত-উপস্থিতিতে চোখ ভিজে আসে কুয়াশায়। 'কুয়াশা' শব্দটি ব্যবহার করে কবি বিমল গুহ এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন। অতীত জাগ্রত, মৃত নয়। তবে তা কুয়াশাচ্ছন্ন। এই কুয়াশায় ভিজে যায় চোখ। অর্থাৎ অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি এক গভীর মমত্ববোধ তুলে এনেছেন তিনি। অন্যদিকে জন্মদিন কিংবা বর্তমান অট্টহাসিতে পূর্ণ। এক ধরনের ভোগবাদিতা ভর করে বর্তমানে এসে। এবার এসে দাঁড়ায় চতুর বালক। এই চতুর বালক সেজে কে আগামী জন্মোৎসবের দিন গোণে। এ এক করুণ পরিণতির ইঙ্গিত।

কবি বিমল গুহ কি সেই পরিণতির দিকেই ধাবিত হচ্ছেন ক্রমশ? অন্তত তাঁর কাব্য-পাঠককে তো এভাবে ভাবিয়েও তুলতে পারে। ২৭ অক্টোবর '০২ কবি বিমল গুহ'র পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিক। একজন কবির জন্য পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ শুধু তাঁর সংসারবাদী জীবনের উজ্জ্বলতার পক্ষপাতিত্বে নয়; তাঁর শিল্পের বাতাবরণে সৃষ্টির সংবেদনশীলতার গভীরে এক পশলা বৃষ্টির উদ্দামতার জন্যে।

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধের সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies