নব্বই দশকের নব্বই জন কবির কবিতা নিয়ে সংকলন বেরিয়েছে। কবির সংখ্যাধিক্য গর্ব করার মতোই। এর
অনেকেই ঝরে যাচ্ছেন ইতোমধ্যে। আবার এই তালিকার বাইরেও রয়েছেন অনেক কবি, যাঁদের মধ্যে টিকে থাকার মতো,
শীর্ষে উঠে আসার মতো কবিও রয়েছেন। আমি অন্তত একজনের নাম জানি- সুমন সরদার (১৯৬১)।
সুমন সরদারের কিছু বিক্ষিপ্ত কবিতা পড়েই সনাক্ত করতে পেরেছিলাম যে- 'একজন আসছেন'। তাঁর 'বিপন্ন বসবাস' (১৯৯৫),
'আগুন রঙের ডানা' (১৯৯৬), 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' পড়ে আমার পূর্বানুমান সত্য বলে মেনে নিয়েছি।
শাহবাগের আড্ডায় তাঁকে দেখা যায় না। স্বভাবে লাজুক ও নিভৃতচারী বলে সমকালীন কবিদের সঙ্গে সখ্যস্থাপনের সুযোগ
খোঁজেন না। তবে অনেক মুখ্য কবির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ নিবিড় ও স্থায়ী।
বহুদিন ভাবছি সুমনের কবিতা নিয়ে লিখবো। নব্বই দশকের কবিতা নিয়ে সম্ভবত আমার লেখাই প্রকাশিত হয়েছে বেশি।
পাক্ষিক 'অন্যদিন'-এ বইপত্র কলামে নিয়মিত লেখার সুযোগ পেয়ে এ কাজটি আমি করেছি। আর চোখের সামনে দেখেছি অনেক
বন্ধু তাঁর সম্পর্কের সুতো শিথিল করে নিয়েছে। ভাগ্যিস, নিজের দু'টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাউকে চাপ দিই নি। অবশ্য
এ কথা ঠিক যে, আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই লিখছি। তেমনি সুমনের কবিতা নিয়ে লেখার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। তাঁর সকল
লেখা আমার সংগ্রহ। এমনকি গত বছরে (২০০০) প্রকাশিত অথচ অগ্রন্থিত অধিকাংশ কবিতাও আমার সংগ্রহে রয়েছে। সুমনের
কবিতার আমি এক মুগ্ধ পাঠক। আমার হাতে সুমনের ১৫টি কবিতা আছে। গত বছরে অর্থাৎ ২০০০ সালে এ কবিতাগুলো দেশের
জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক-এ ছাপা হয়েছে। আমি গত বছর লিখেছি তিনটি কবিতা আর ছাপা হয়েছে মাত্র একটি।
সেখানে আমার দশকের কবিসহযোদ্ধার এতগুলো কবিতা প্রকাশ তাঁর উত্থানপর্বের সফলতাকেই নির্দেশ করে। ১৫টি কবিতার
মধ্যে আজকের কাগজ-এ চারটি, জনকণ্ঠ-এ তিনটি, সাপ্তাহিক খবরের কাগজ-এ দু'টি এবং দৈনিক ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ,
বাংলার বাণী, দৈনিক জনতা, সাপ্তাহিক চলতিপত্র, মাসিক আজকের সভ্যতা পত্রিকায় একটি করে কবিতা ছাপা হয়েছে। দেশের
প্রথম শ্রেণীর ও প্রগতিশীল কাগজগুলোতে সুমন এই এক দশক ধরে লিখে চলেছেন। সকল রকম দলবাজির ঊর্ধ্বে থেকে তিনি
তাঁর কাব্যসাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারুণ্যের আড্ডায়ও তাঁকে নিয়মিত দেখা যায় না। তাঁর বাসাতেই আমাদের জমে ওঠে
তুখোর আড্ডা। নিজেকে জাহির করছেন না তিনি, কিন্তু কবিতার মধ্যে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেন কোথায়? তাঁর
অতি সাম্প্রতিক কবিতাগুলো পড়লেই আমরা কবি সুমন সরদারকে আবিষ্কার করতে পারি।
সুমন সরদার প্রকৃতিলগ্ন কবি। প্রকৃতি থেকেই তিনি আহরণ করেন কবিতার উপাদান। প্রকৃতির সদস্য আর মানুষের অকৃত্রিম
বন্ধু বৃক্ষ হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার বন্দনার বিষয়-
১.
পরিপূর্ণ বৃক্ষ থেকে একটি পাতার ঝরে পড়া
আমাকে প্রায়শ: দগ্ধ করে
(মেঘচোখ)
২.
বৃক্ষ কোনো ছলনা জানে না, তাই
কখনো কখনো মানুষ নিজেই বৃক্ষ হয়ে ওঠে
(আমি বৃক্ষ তুমি স্বর্ণলতা-এক)
৩.
ফুল নেই, পাখি নেই, ভ্রূণ ধারণের বৃক্ষ নেই
হাহাকার শুধু হাহাকার!
(তার খোঁজে)
৪.
বৃক্ষের শাখায় ঠেস দেয়া বিকেলের ক্লান্তসূর্য
নির্জন গার্হস্থ্য খোঁজে...
(খোঁজা)
৫.
মালীর আকতি বৃক্ষে নয়
সরাসরি আকাশের কাছে
(আকুতি- দুই)
পনেরটি কবিতার পাঁচটিতেই সরাসরি বৃক্ষ আর বাকিগুলো খুঁজলে ফুল, বাগান, ছায়া, মালী, ঘাস প্রভৃতি শব্দ থেকে বৃক্ষের
উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সত্তরের অন্যতম কবি নাসির আহমেদের 'বৃক্ষমঙ্গল' কাব্যের কথা মনে পড়ে যায়।
কিছুদিন আগে আশির কবি মজিদ মাহমুদ বৃক্ষ বিষয়ক কবিতার একটি নির্বাচিত সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। কবিতার
পরিবেশ চিন্তার যে অনুপ্রবেশ তা আজকের নয়। সুমনের কবিতাও পরিবেশ বন্দনার অঙ্গীকারকে ধারণ করে।
ত্রিশের আধুনিক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্যকে মনে করেন 'কবিতার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র'। এ বিচারে সুমনকে আমরা
পুরোপুরি কবি বলে মেনে নিতে পারি। দ্বিতীয় কাব্য থেকে তিনি ছন্দ-সচেতন। আর এখন ছন্দ নিয়ে তিনি খেলা করতে পারেন।
আলোচ্য পনেরটি কবিতাই ছন্দোবদ্ধ। এর মধ্যে চারটি কবিতায় রয়েছে অন্তর্মিলযুক্ত। লক্ষণীয় হলো এই চারটি কবিতাই
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এবং পর্ববিন্যাসে মন্দাক্রান্তা ছন্দের চাল গ্রহণ করেছে। সংস্কৃত ছন্দের এই মন্দাক্রান্তা আঙ্গিক
সুমনের ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্যের প্রমাণ দেয়। বাকিগুলোও ছন্দোবদ্ধ। অক্ষরবৃত্তই তার প্রধান বাহন। 'চোরাভঙ্গি' নামের কবিতার
প্রথম চার লাইন অবশ্য স্বরবৃত্ত-
"কেমন করে আসলো রাধা
বৃষ্টিঝরা অন্ধপ্রাতে
আড়াল করা দুইটি মাথা
বেরিয়ে এলো আমার হাতে।"
চরণগুলো সুমনের সৃষ্টি না উদ্ধৃতি তা অবশ্য বুঝতে কষ্ট হয় কবিতাটির বাকি চৌদ্দ চরণের ছন্দোস্বাতন্ত্র্যের কারণে। আমরা
সুমনের মন্দাক্রান্তা ছন্দের দিকে একটু গভীর নজর দিতে চাই। কবিতা চারটির মাত্রাবিন্যাস হলো ৮+৭+৭+৫। 'এইখানে
মৌনতা' ও 'পরিত্যক্ত' কবিতাদু'টোর অন্ত্যমিল বিন্যাস কখখক এবং 'জীবনপাত' ও 'আমি বৃক্ষ তুমি স্বর্ণলতা-দুই'
কবিতাদু'টোর অন্ত্যমিল বিন্যাস ককখখ। এ রকম বিন্যাসে কবিতার মানের কোনও হেরফের ঘটে না। তবু কবিতার অঙ্গরূপ
বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা থাকে। মাত্রাবৃত্তে পাঁচ, ছয়, সাত মাত্রার প্রচলনই বেশি দেখা যায়। সেখানে আট মাত্রার চাল দিয়ে
সুমন দক্ষতা দেখাতে চেয়েছেন। 'এ কোন অবতার', 'এ কেমন লুকোচুরি', 'এ আমার জাতিস্বর' এ সকল বাক্যাংশের পাশাপাশি
যখন 'এইখানে মৌনতা' বাক্যাংশের প্রয়োগ দেখি, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, কেবল একমাত্রা বৃদ্ধির জন্যেই সুমন
'এখানে'র বদলে 'এইখানে' লিখেছেন। একটু ঘুরিয়ে লিখলেতো এ দুর্বলতা এড়ানো যেতো। তবে আধুনিক কবিতার অন্যতম
আধুনিক অলঙ্কার যে চিত্রকল্প, তা তাঁর কবিতায় আছে কুশলী নির্মাণে। দু'টি চিত্রকল্প উদ্ধার করা যেতে পারে-
১.
"পাখিগুলা বসেছিলো বৃষ্টিহীন রোদের বাগানে
মালী সারাদিন নিষ্ঠা-প্রহরা বসিয়ে কেঁদেছিলো
নীল আকাশটি কালো হয়ে চুপচাপ বসেছিলো
মুখটি গোমরা করে
(আকুতি- তিন)
২.
এই হাত ধরে যে একদা ভেসে যেত
ঘনমেঘমালার অরণ্যে
সেখানেই বুঝি হারিয়েছি বামপাঁজরের দেবযানী
মেঘের কপালে তাই সিঁদুরের রঙ মেখে মেখে
আমি আজও মস্নানরত তার অপেক্ষায় বসে আছি
(তার খোঁজে)
প্রথম উদ্ধৃতির 'রোদের বাগানে' শব্দবন্ধটি এড়ানো গেলে নির্মিত চিত্রকল্পটি আরো পরিপাটি হতো। তবু দু'টি চিত্রকল্পই
উজ্জ্বল ও অসাধারণ।
সুমন সরদারের কবিতায় মূল সাফল্য প্রতীক নির্মাণে। কবিতার আর সকল অলঙ্কারের আধিক্য ও ঔজ্জ্বল্য ছাপিয়ে তাঁর কবিতায়
প্রতীক-অলঙ্কারই তীব্র ও তীক্ষ্ন হয়ে ফুটে ওঠে। যেমন সপ্তডিঙা, সপ্তমুখী, জনারণ্য, সূর্যের ঘ্রাণ, চাঁদের আড়াল, নিদ্রাবন,
হরিণবাড়ি, তালা প্রভৃতি অনুষঙ্গ মিলিয়ে নির্মিত হয়েছে চমৎকার প্রতীক-
"সপ্তডিঙা ভাসিয়ে বেড়াই সপ্তমুখী জনারণ্যে
সূর্যের আঘ্রাণে ক্লান্ত হই
চাঁদের আড়ালে নিদ্রাবনে ক্রন্দনের সুর বাজে
নাই, নাই কোথাও যে নাই
সকল পথেই পাতা আছে হরিণবাড়ির তালা।"
(খোঁজা)
লক্ষ্য করা যায় যে, সুমনের কবিতায় বেশ কিছু শব্দ ঘুরে-ফিরে এসেছে। 'মদনদেব', 'কৃষ্ণ', 'ক্লান্ত', 'বৃক্ষ', 'টিপ',
'রঙ' প্রভৃতি শব্দের প্রতি সুমনের একধরনের পক্ষপাত রয়েছে। প্রত্যেক কবিই কিছু কিছু শব্দের প্রতি দুর্বল থাকেন।
এই শব্দগুলো বিশ্লেষণ করেও কবির চারিত্র্য খুঁজে নেয়া যায়। সুমনের বাকি জীবনের কবিতা থেকে কোনও গবেষক
হয়তো তা খুঁজে বের করবেন। আমি সূত্রটি মাত্র উল্লেখ করছি।
কবি সুমন সরদার আমার সময়ের কবিসৈনিক। বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে আমরা বন্ধুকবি হয়ে উঠেছি। তাঁর কবিতার একজন
মনোযোগী ও বিশ্লেষক পাঠক হিসেবে আরও কথা হয়তো বলা যায়। এক বছরের সময়পর্বে প্রকাশিত কবিতা নিয়ে এর
বাইরে কিছু বলতে গেলে তা কেবলই বন্ধুকৃত্য হয়ে উঠতো, সমালোচনা নয়। আমি এই ক্ষুদ্র পরিসরে সুমনের কবিতার
ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতা, সম্ভাবনা-সীমাবদ্ধতা উভয় দিকই আলোচনা করেছি। আমি মনে করি যে শুধু প্রশংসা
নয়, প্রকৃত সমালোচনাই একজন কবির বেড়ে ওঠার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক বন্ধুকবির অনুরোধে
তাঁদের গ্রন্থের আলোচনা লিখতে গিয়ে বন্ধুত্ব হারিয়েছি। আমি মনে করি যে, এটাই আমার লেখার প্রাপ্য সমালোচনা।
এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এরকম গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোতে হয়। কবি সুমন
সরদার সে কথা জানেন বলেই মানি। আর এ কারণেই সুমন হয়ে উঠবেন নব্বই দশকের কবিদের শীর্ষে। আমাদের
প্রত্যাশা পূরণের কারণে নয়, স্বীয় কবি প্রতিভার কারণে সুমন সরদারের এই অর্জন শুধু সময়ের ব্যবধান।
(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)
ড. তপন বাগচী, কবি, প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার; উপ-পরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
|