আধুনিক কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাবের গভীরতা; আর বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি। ছন্দ এখানে সমুদ্রের
ঢেউয়ের মত, তাললয়হীন তালে সুদূর থেকে সৈকতে বিস্তৃত। ভাষা হিজল-তাল-আমবাগানের গেঁয়ো পথের বাতাসের
মত সাবলীল, মানুষের কথা বলার প্রাণের কাছের ভাষা। ভাব-সমুদ্রের তলদেশের বিরাট জগৎ আর পরিধি সমুদ্রেরই
মত বিশাল বিস্তৃত। রস যুগযন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। অলঙ্কার চারুকলার ছাত্রদের মত। প্রতীক সৃষ্টি আধুনিক কবিতার একটা মূল
বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে গভীর ব্যঞ্জনা। আধুনিক কবিতার যা প্রধানতম লক্ষণ।
কবি কিংবা কাব্যরসিকের তা অজানা নয়। 'মাকাল ফল' কথাটা বললে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না তার অন্ত:সারশূন্যতার
কথা। কিন্তু 'মাকাল ফল' দেখতে তো সুন্দর। তাহলে সুন্দর অথচ সারহীন এরকম একটা অভিধা পেতে পারি। আবার
'মাকাল ফল' বনের লতায় ঝুলে থাকে সবার দৃষ্টির অগোচরে, সেটাও একটা অভিধা। কিংবা বনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি
করে- এরকমও ভাবা যায়। আবার তার স্বাদ তেতো- এও একটা অভিধা। এ সবই নির্ভর করে শব্দটার যথাস্থানে প্রয়োগের
ওপর। অর্থাৎ একটা বিশেষ শব্দ শুধু একটা নির্দিষ্ট বিশেষ অর্থ না বুঝিয়ে নানারকম অভিধায় তার অর্থ ভিন্ন ভিন্ন
দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করলে সেটাই ওই শব্দের ব্যঞ্জনা। একই প্রিজমের মধ্যে আলোর যেমন সাতটি রঙ ধরা পড়ে,
তেমনি একই শব্দের মধ্যে নানা অর্থ প্রবীষ্ট হয়ে নানা রঙের আলোক বিচ্ছুরণ ক'রে হিরকদ্যুতি সৃষ্টি করে; পাঠকের
মনকে রাঙায়, আলোকিত করে। অর্থাৎ কবি যা লিখছেন, কবির ভাবকে প্লাবিত করে তা পাঠকের মনে ভাবনার জাগরণ
তোলে। ছোট্ট একটা ঢিল যেমন সারা পুকুরের জলে মৃদু ঢেউয়ের দোলা বিস্তার করে যায়, স্নিগ্ধ আলোড়ন তোলে-
তেমনি। মানুষের মন যেমন গভীর, অতলান্তিক, বিচিত্রমুখী; নানাভাবে বিশ্লিষ্ট, নানা রঙে বিকীর্ণ; ব্যঞ্জনাও কবিতার
ক্ষেত্রে সে রকমই।
জীবনানন্দের কথাই ধরা যাক- 'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ'। 'অদ্ভুত আঁধার' শব্দটা কবিতায়
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। যেমন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে- 'থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, বনলতা
সেন' পঙক্তিতে 'অন্ধকার' এবং বনলতা সেন'। কবির কল্পনাকে ছাড়িয়ে ভাব এখানে অনন্তের অভিসারী। বক্তার বক্তব্যের অতীত
যে বক্তব্য- তা-ই ব্যঞ্জনা। 'তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে' কিংবা 'আকাশলীনা'
কবিতায় 'নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে' বা 'তোমার হৃদয় আজ ঘাস' গভীর ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ পঙক্তি। এখানে 'বেতের
ফলের মতো ম্লান চোখ', রুপালি আগুন', 'হৃদয় আজ ঘাস' গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্রনাথের 'বাঁশি'
কবিতায় দেখতে পাই ব্যঞ্জনা, 'দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো' কিংবা 'এক বৈকুণ্ঠের দিকে' অথবা 'এ গান যেখানে
সত্য/অনন্ত গোধূলিলগ্নে/সেইখানে/বহি চলে ধলেশ্বরী' পঙক্তিতে। 'মাতালের প্রলাপ', 'এক বৈকুণ্ঠ', 'অনন্ত গোধূলি',
'ধলেশ্বরী' সার্থক ও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। সার্থক ব্যঞ্জনা একটা কবিতাকে নিয়ে যায় জ্যোতির্ময় আলোকের
সুউচ্চ কল্পবলয়ে। আধুনিক কবিতায় ব্যঞ্জনার তাই এত গুরুত্ব।
বাংলাদেশের তরুণ কবিদের মধ্যে সুমন সরদার অগ্রগণ্য একজন। তিনি তাঁর কবিতায় দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি এর স্বাক্ষর
রেখেছেন তাঁর নানা কাব্যগ্রন্থে। সুমন সরদার তাঁর কবিতায় গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে নিরলস অনুসন্ধানী
এবং সার্থক প্রয়োগকারী। এর প্রমাণ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থে পর্যায়ক্রমিক ভাবে উত্তরণ।
উত্তরোত্তর তিনি অতিক্রম করে গেছেন নিজকে।
'বিপন্ন বসবাস' কাব্যে দেখি 'তবু কী শঙ্কিত মধু জাগে স্বপ্নের দুপুরে' (কবিতার ফুল ছুঁয়ে) কিংবা 'বারুদের
গন্ধে ওরা নিসর্গে রক্তের দাগ কাটে' (ওরা ভুলে যায়) পঙক্তিতে 'শঙ্কিত মধু', 'স্বপ্নের দুপুরে', 'নিসর্গে রক্তের
দাগ' সার্থক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। 'হিমাঙ্কের সদ্য নিচে প্রতীক্ষা' (একই কষ্টের পাথর) সার্থক ব্যঞ্জনাবহ। ব্যঞ্জনার
উত্তরণ দেখি তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ 'আগুন রঙের ডানা'য়-
"জনমের ব্যবধান ছিল
জীবন শুরুর ব্যবধানও ছিল ঢের
এক বাঁশঝাড় থেকে অন্য ঝাড়ে কোন এক বাঁশ
যেমনি নেতিয়ে পড়ে
তেমনি দু'জনে সকলের অগোচরে
ঢের হেলে পড়ি।"
(সেই চলে গেলে)
পঙক্তিতে জীবনানন্দীয় ব্যঞ্জনার সুর ধ্বনিত। 'বিপন্ন বসবাস'-এর চেয়ে 'আগুন রঙের ডানা'য় ওড়াউড়ি 'ঢের' স্বাচ্ছন্দ্যের
উঁচুতে। 'প্রতিরোধ' কবিতায়-
"এমনি অতলে আবছা আলোয় সেদ্ধ কবিতা
উপহার দিয়ে কোন লাভ নেই"
পঙক্তিতে 'আবছা আলোয় সেদ্ধ কবিতা' ব্যঞ্জনাবহ।
সুন্দরকে আরও সুন্দর করে প্রসাধনী, অলঙ্কার। অলঙ্কার ও প্রসাধনী নারীকে করে তোলে সুন্দর ও মোহনীয়। কিন্তু
তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে করে তোলে ঐশ্বর্যময়ী। ব্যঞ্জনা কবিতার ব্যক্তিত্ব। 'আমাদের বয়স থাকে না' কবিতায়-
"সুখের বয়স নেই- তুমি জানো না তা?
আমি জানি তুমি জানো, তোমার শরীরে
বরফের দেশ আছে পচনের আগে।"
গভীর ব্যঞ্জনা কবিতাটার ব্যক্তিত্বকেই বিকশিত করেছে। অসম্ভব সুন্দর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে-
"মীমাংসাবিহীন কোন সাপের ফণার মতো রাত্রি"
(কে যেন এলো না)
"প্রখর রোদ্দুরে ট্রেনহীন রেললাইনের মতো
ভালবাসা খাঁ খাঁ করে"
(কী আশ্চর্য পড়ে থাকি)
"পারদের থিতু স্বাদে আদি পৃথিবীর গন্ধ পাই
মনে হয়, থার্মোমিটার রুগী আর
জিহ্বাটি থার্মোমিটার"
(আর্তি, আদি পিতার গন্তব্যে)
"সোনালি ধানের অহঙ্কারে, কাঁচা রোদের বাগানে"
(নোনা গন্ধে পড়ে আছি)
ইত্যাদি পঙক্তি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। 'বিপন্ন বসবাস' কাব্যের চেয়ে 'আগুন রঙের ডানা'য় ব্যঞ্জনার ব্যবহার
বেশি এবং বেশ পরিপক্ক। কবি সুমন সরদার যেন উত্তরণের সিঁড়ি বেয়ে নিজকেই অতিক্রম করে গেছেন নিজে বারবার। একজন
মহৎ এবং সার্থক শিল্পীর জন্য যা একান্ত আবশ্যক। সুমন সরদার তাঁর পরবর্তী কাব্য 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়'-এ এ
উত্তরণ আরও উজ্জ্বল। এ কাব্যের ব্যঞ্জনা আরও শক্তিশালী, গভীর এবং তাৎপর্যবহ
"ঠোঁটের আড়ালে মুচকি হাসির আহাজারি ঝরে!
আহা! সবটুকু বিশ্বাস যদি এমনি মিলিয়ে যেতো
দু'দিন পরেই তবে তার দেহ নিলাম হতো না"
(তিন পুরুষের সংসার)
পঙক্তিমালা গভীর ব্যঞ্জনাবহ। 'মুচকি হাসির আহাজারি' চমৎকার ভাব দ্যোতক।
"অন্যদিকে ধুকপুক হৃদয়ের ক্লিষ্ট অন্ধকার
বালির সৈকত বেয়ে নেমে যায় গভীর সমুদ্রে"
(কোন দিকে যেতে চাও)
wKsev
"এই রাত কী সন্ন্যাসমাখা অন্ধকার
ফুরিয়ে যাবার আগে অহঙ্কারে মুখ ফিরায় না।
দিনের শরীরে ছোটে বাক্সবন্দি রাতের অধর
ছেঁড়া অংশ কিছু জমা রেখে যায় জানালার পাশে।"
(নিরন্তর চেয়ে থাকা)
এরকম বিত্তবান পঙক্তি একজন চিত্তবান সুন্দর শিল্পীর পক্ষেই নির্মাণ করা সম্ভব। 'ক্লিষ্ট অন্ধকার' বা 'সন্ন্যাসমাখা অন্ধকার'
চমৎকার ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। আধুনিক কবিতার সার্থক শরীর নির্মাণে সুমন সরদার নিঃসন্দেহে দক্ষ কারিগর।
এমনই ব্যঞ্জনাদ্যোতক আরও দু'চারটে পঙক্তির উল্লেখ না করে পারছি না-
"যে আঙুল দিয়ে কোনো সন্ন্যাসী মৃদু ইশারায়
সন্ধিপত্র রচনা করেন,
পাথরসিঁড়িতে ঘষে হয় সেই আঙুল বিমূঢ়!
দাগকাটা ঘরে সিংহ-দরজা ভাঙতে ভাঙতে
ভোরের আকাশে সূর্য উঠলে
চোখের পাপড়ি খসে পড়ে যায় আপনার হাতে।"
(সুন্দর থেকে খসে যাবে)
"ঘরের জানালা খোলা রাখলেও
ঢুকবে নাতো রাতে কোনো আকাঙ্ক্ষার আলো
সকালের ঘুমভাঙা বারান্দার বিবস্ত্র শূন্যতা
প্রতিদিন তাই হাহাকার করে!"
(জমকালো রাত)
"রোদের জরায়ুতে আবারও একদিন
ফসলি অভিসার জন্মে ধীর লয়ে"
(প্রত্যাশা)
"সাতঘাটে নিরিবিলি জলের নাচন নেই আর
কেননা ঘুঙুরবাজা শরীরের সবটুকু তার
চিতার আগুনে পোড়ে।
বুঝেছি এ পথে ছিল সুখহারা নীল অন্ধকার
সময়ে ফেরার এক গোপন চুক্তির পথে দেখি
সারি সারি বেদনায় পূর্ণ বনভূমি।"
(কী যে ভুল ছিল)
"জবাবদিহির বিকেলের ছাদে
আমিও দগ্ধ সংকোচ ছুঁড়ে দেবো-
আবার মানুষ হয়ে ফিরে যাবো মানুষের কাছে!
(আবার ফিরে যাবো)
ইত্যাদি পঙক্তিতে চমৎকার ব্যঞ্জনা আভাসিত। ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে সুমন সরদার সাবলীল। অনায়াসসাধ্য পদচারণায় কত সহজেই
তিনি কুড়িয়ে নিয়েছেন অসম্ভব ব্যঞ্জনাময় শব্দমালা। আধুনিক কবিতার মানদণ্ডে সুমন সরদারের কবিতা উত্তীর্ণ। তাঁর
কবিতা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ইতোমধ্যেই তাঁর কবিতা একটা নিজস্ব স্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে।
তবুও কোন সৎ ও আদর্শ শিল্পীই তুষ্ট হতে পারেন না নিজের সৃষ্টিতে। প্রতিনিয়ত সীমায়িত জীবনের গণ্ডি থেকে তাঁর
যাত্রা অসীমে; সুন্দর থেকে সুন্দরতর, অনন্ত সৌন্দর্যের অভিলক্ষে। সুমন সরদারের কবিতাতেও সে যাত্রা নিরন্তর। বয়সী
তরুণ কবির সামনে রয়েছে এখনও ঢের ঢের সম্ভাবনার চারুপথ। তাঁর কাছে আমাদের তাই রয়েছে প্রত্যাশার পাহাড়।
সগৌরবে, সদর্পে তিনি যেন তাঁর সৃষ্টিতে রেখে যেতে পারেন কালের অমর স্বাক্ষর- এ শুভ কামনাও থাকলো আজকের
এ পরম ক্ষণে। সুন্দরের খোঁজে তাঁর এ নিরন্তর যাত্রা থাক অব্যাহত। সে আশ্বাস তিনিই শুনিয়েছেন-
"হায়রে স্বপ্ন! স্বপ্নের সাথে স্বপ্নের এক প্রাসাদ গড়ার
স্বপ্নটা হলো শুধুই স্বপ্ন!"
প্রত্যাশা এবং বিশ্বাস- সেই স্বপ্নই সুমন সরদারকে নিয়ে যাবে সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায়। যেখানে যাবার জন্য তাঁর
নিরন্তর প্রয়াস ও রক্তক্ষরণ।
(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)
* ড. সন্তোষ ঢালী; কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক; সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
|