বাণী ও বার্তা সুমন সরদারের কবিতার প্রধান চরিত্র। "সংঘর্ষের বিস্ফোরণে নক্ষত্র কাঁপুক,
পৃথিবীটা ভেঙে হোক দ্বিখণ্ডিত নারকীয় মাঠে, ..... বেরিয়ে আসুক অন্যরকম পৃথিবী, যার
কোনো সূর্য নেই পিতা নেই কক্ষ নেই, অন্ধকারে বিড়ালের চোখ নিয়ে জন্মাবে মানুষ!
....... পৃথিবীর আদিপিতা অনাদিকাল ধরে করবে না রহস্যজড়ানো নারকীয় দুঃশাসন!"
হ্যা, সুমনের কবিতা অনেকটাই এরকম, প্রধানত এরকম। চিন্তার ভিতরের স্তরে যে ভাঙাগড়া
যে পরিবর্তন অনুবর্তন বাইরের অভিঘাতে, সেই টালমাটাল অস্থির অলগ্ন অস্থিত ভাঙাগড়ার
শীর্ষে কাব্যবর্ণে নির্মিত হয়ে ওঠে যে কাব্যস্তবক, সেই স্তবক বা চরণ কিন্তু প্রতিনিধিত্ব
করে না সকল অস্থিরের। কাব্য গড়নের বিশেষ ধরনের কারণেই শীর্ষ বা প্রধান বা বক্তেয় স্তবকের
বার্তা হয়ে ওঠে নির্মাখন। জন্মের সকল আয়োজনচিহ্ন ঝেড়ে ফেলে এই বার্তা হয়ে ওঠে একা,
স্বয়ম্ভু এবং রূপান্তরশীল একক কাঠামোয় সনাক্তযোগ্য। দার্ঢ্য আছে কাঠিন্য আছে কিন্তু
রূঢ়তা নেই। তার অর্জিত জ্ঞান বলে, "অরণ্যের মধ্যভূমে আগুনের লকলকে জিব, বৃত্তাকারে
ছড়িয়ে পড়লে, সবুজ বাঁচে না! ....... কাঁধ থেকে বাহু, বাহু থেকে হাতে, হাতের
আঙুলে, ব্যথার রাজত্ব নির্বোধে ছড়িয়ে পড়ে!" এই স্থূল তীব্র অসহনীয় পরিস্থিতিতে কবি
যখন বহির্ব্যবস্থার দ্বারস্থ তখন প্রতিকার ব্যবস্থার সূচনাতেই পারদের স্বাদে কবি পান 'আদি
পৃথিবীর গন্ধ'। কী করুণ, কী করুণ!
এতো বদলাচ্ছে পাল্টাচ্ছে রূপান্তরিত হচ্ছে আর পুরনো খোলস পাল্টে নতুন চামড়া উঠছে
পৃথিবীর তাবত অস্তিত্বের তবু বদলাচ্ছে না কিছুই? শূন্যতার কী ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব! নতুন নতুন
আর নতুনের জন্যে আমাদের যে হাহাকার, পুরনো বদলের যে তৃষ্ণা, এবং এই হাহাকার ও
তৃষ্ণার বিপরীতে আমাদের যে দৌড়, বহিরঙ্গের এতো যে আয়োজনের চমক এ সবই কি অবিরল
হারাতে থাকে ফাঁকির মধ্যে? নইলে কবি সুমন সরদার কেন সকল নেতিবাচকতার ব্যর্থতার বেদনার
বিবরণ শেষে 'অন্যরকম পৃথিবী'র আকাঙ্ক্ষা করেন; যেখানে, যে পৃথিবীতে 'পৃথিবীর আদি
পিতা গোপনে অনাদিকাল ধরে, করবে না রহস্য জড়ানো নারকীয় দুঃশাসন!'
সুমন সরদারের কবিতায় প্রতিশব্দ এবং শব্দের ছায়া নির্বাচনের ক্ষেত্রে খানিকটা সমস্যা আছে,
যে সমস্যা শব্দের অর্থ এবং শব্দেরসংসার চরণে অস্পষ্টতার সৃষ্টি করে। যেমন উপরোদ্ধৃত চরণে 'পৃথিবীর
আদি পিতা গোপনে অনাদিকাল ধরে' বলা হয়েছে। এই গোপনে কি আসলেই 'গোপনে'? পরের
চরণে 'করবে না রহস্য জড়ানো নারকীয় দুঃশাসন' চরণের 'রহস্য জড়ানো' শব্দবন্ধটি কিন্তু আগের
চরণের 'গোপনে' শব্দটিকে সার্থক যথাস্থানে রাখছে না। এটি প্রতিশব্দে বা শব্দের ছায়ায় তার স্থান
বদলাচ্ছে, আয়তনে সম্প্রসারিত হয়ে 'অন্তরালে' 'অগোচরে' ইত্যাদি শব্দের ভূমি গ্রাস করছে।
তবে ঘোষণার দৃঢ়তা শব্দস্থাপনের দ্বিধা দুর্বলতা ঢেকে দিয়ে বাণী বক্তব্যকেই সর্বোচ্চে সর্বাগ্রে
স্থাপন করেছে।
"আমাদের বাড়িটার চারপাশে হিজলের ছায়া, তবু বড় ভালবেসে জড়িয়েছি একাকী ডাঁটায়"
(বৃত্ত থেকে) মধুর, মধুর! মানুষের বৃত্তে মানুষ, কবির বৃত্তে কবি, এমনকি কবিজায়াও তার
নিজের বৃত্তে গোপনে সঞ্চয় করে 'আবরণে কর্ম ফলাফল'। এবং "আমি যদি জেগে থাকি নির্ভীক
চোখের পাহাড়ায়, এ গল্প ছড়িয়ে পড়ে দূরে বারুদের তীব্র ঘ্রাণে"। কি কাব্যিক বারতা বহন
করে এই দুই চরণের ধ্বনি। শব্দ তার অর্থ অতিক্রম করে কোন বৃত্তে যায় সে-ও অসনাক্ত থেকে যায়।
তবুয়ো, কি যেন কি জরুরি কথা, আমাদের সকলের সংবাদ বর্ণিত এতে। এজন্যেই বোধ হয় কবির
সিদ্ধান্তজালে জীবনের অনেক খুচরো শামুক গুগলি আর জলজ জঞ্জালের সাথে উঠে আসে "জীবন
জালের ফাঁকে মমতার সমুদয় বৃদ্ধি, বৃত্ত থেকে হেসে ওঠে ভূমিষ্ঠ হবার যন্ত্রণায়"।
স্মৃতি আর নিজের ও সকলের ফেলে আসা পথের ঘটনা, নদী ও বৃক্ষ, ফসল ও তৃণের ছায়া কবিকে
অনুসরণ করে সর্বক্ষণ। প্রায় কবিতার মধ্যেই স্মৃতির ঘ্রাণ এসে ছুঁয়ে যায় সহসা, সে ছোঁয়া
লেগে থাকে অনেকদূর গমন পর্যন্ত, হঠাৎ কখনো প্রবল হয়ে ওঠে কেন তা কি কবির জানবার কথা?
পদ্মার ভাঙন গ্রাস করেছে তার স্মৃতির সমাহার। নদীভাঙনের ভূমিগ্রাস খুব প্রবল ঘটনা। কিন্তু
সুমন সরদার যখন বলেন, 'পালক গজানো কিছু পিঁপড়ের মতো রাক্ষসী পদ্মার বুকে মিশে গেছে'।
তখন 'রাক্ষসী' শব্দটি ছাড়া ঐ ঘটনার মর্মন্তুদ ভয়ঙ্করতায় কোনোভাবেই আমরা পৌঁছুতে পারি না।
ঘটনাও (দুর্ঘটনা?) আমাদের মধ্যে বেদনা সঞ্চারিত হতে দেয় না। পক্ষান্তরে 'আকাশের ঠোঁটে
খণ্ড খণ্ড মেঘ ওড়ে!', 'ঘাসের নরম ডগা থেকে, আঙুল আলতো করে কতদিন ভোরের শিশির, ছ্বুয়েছি,
গভীর মমতায় লাগিয়েছি ফাটা ঠোঁটে!' আমাদের সামনে অপরূপ স্মৃতির টুকরো এনে ঝুলিয়ে
রাখে। এই চরণ চতুষ্টয়ের মধ্যে কিছু বিশ্লেষণাত্মক অতিরিক্ততা ('নরম' ডগা, আঙুলে 'আলতো
করে', 'গভীর মমতায়' লাগিয়েছি) ব্যতীত চিত্রটি অনেকদূর পর্যন্ত আমদের সাথে করে নিয়ে বেড়ায়।
গল্প বলার কবিতায় (ছবি আছে শব্দ নেই) আপাত দীর্ঘ এই কবিতার মধ্যপথে 'সূর্য ডোবার এখনও
ঢের বাকি, কম করে হলেও অন্তত ভার বহন করতে পারি, এমন মাত্র একটি গল্প বলো।' হায় কবি,
হায় পাঠক! জীবন যেখানে গল্পেরও অধিক মাত্রায়, বেদনা ও লাবণ্যে লতিয়ে ওঠে, সেই জীবনের
গল্পের কোনো বিচ্ছিন্ন গল্প থাকে না। কোনো অংশের বা অংশসমূহের ভার বহনও করা যায় না।
তবু আমাদের জীবনের গমনতো গল্পের ভার অন্যের ওপরে অর্পাতে অর্পাতে, গল্পের ভার বহন করতে
করতেই। সুমন সরদার এই পঙক্তি-কতিপয়ে কাব্যের মাত্রা ও পরিমিতিতে সর্বোচ্চ ঔৎকর্ষ অর্জন
করেছেন। যদিয়ো এই কবিতার সর্বাংশে তাঁর সকল চরণের বেলায় এটি প্রযোজ্য নয়।
কবি সুমন সরদারের মাত্র কয়েকটি হাতের কাছের (১৯৯৫ সালে রচিত) কবিতা পুনর্পাঠের অন্তে
যে পর্যবেক্ষণ (খুব মনোযোগী নয় যদিয়ো) থেকে দেখতে পাই ওপরে বর্ণিত সর্বত্র প্রযোজ্য নয়
জাতীয় ঔৎকর্ষ এবং চিন্তার মেল হৃদয়াবিষ্ট হয় অনেক অনেক। 'আমার পেছনে কেউ নেই, সামনে
দাঁড়িয়ে আছে অচেনা বাগান' (যতদিন বৃষ্টি না পড়বে), 'মধ্যদুপুরের কোনো গাছে গোলাপ
থাকে না' (ওকে বলা হয় না), 'আয়না ভাঙার যুদ্ধে সঙ্গ দেয় রাতের শহর' (সেখান থেকেই শুরু),
'গুটানো তোমাকে ছুঁয়ে যেতে চাই আর কিছু নয়, লোহার আঘাতে শুধু ভাঙে কবিতার'
(দুঃখগুলো আমার থাকুক সুখগুলো যে আমার), 'দেখতে দেখতে যুগ চলে যায়, ফিরে আসে
কেউ, আবার ঘাতক, এমনি অতলে আবছা আলোয় সেদ্ধ কবিতা, উপহার দিয়ে কোনো লাভ নেই'
(প্রতিরোধ),'মান-অপমান থাক পড়ে ভেতরের জানালায়, রটনার মূল কেটে বেঁচে থাকি অনন্ত
কৌশলে' (রচনা বৈভব গড়ে তুলি), 'জোছনার দামে কিনেছি পাথর' (আজও বেঁচে আছি),
'বন্ধুরা আমাকে ফেলে চলে গেছে দূরে, একাকী মাটির নোনা গন্ধে পড়ে আছি!' (চেয়ে থাকে, আর),
'সম্ভোগের চারদিকে মানুষের বাস, ছিন্নভিন্ন কুরে খায় কাঠঠোকরাদের সহযোগে। মানুষের
নামে সব মায়াময় জ্বালা, ধনুকের বাঁকা পথে শ্রম দিয়ে চায় অমরতা' (এই যদি না হবে),
'সূর্যের দীঘল আলো হঠাৎ একাকী হয়ে যায়' (হঠাৎ একাকী), 'নদীর নাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে,
কিংবা উড়ন্ত মেঘের স্নান বিষয়ে বৈধতা তুলে, নিজেকে অত্যাচারিত করার অর্থ কি"'
(পোকামাকড়ের গল্প বলে)।
প্রতিবেদন আছে, আছে সিদ্ধান্তমূলক ঘোষণা। বাণী ও বার্তাবহ সুমন সরদারের কবিতা একান্তেই
নিজেদের আমাদের তাহাদের কথা বলে। তাঁর কবিতায় আকাশচারিতা কম। একারণেই তাঁর
কবিতা কিংবা/এবং কবিতাংশ পাঠকের মনে সেঁটে থাকে স্মৃতিতে থাকে সংলগ্ন। পঁচানব্বইয়ের
পরে একদশক অতিক্রান্তে ছড়িয়ে পড়া সুমনের কবিতা অনেক এগিয়ে গেছে এটা পর্যবেক্ষণেই বলে।
(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)
* সমুদ্র গুপ্ত ষাট দশকের কবি ও প্রাবন্ধিক।
|