শেখ নজরুল

সুমন সরদারের চেতনা ও বোধে আমি দ্বিধাহীন

কবিতা মানুষের কথা বলে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে সর্বোপরি সমাজ তথা রাষ্ট্রের মুখপত্র হয়ে সর্বত্র বিচরণ করে। আর এ বিষয়টি কাব্য সুষমায় পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন কবি। এসব কথা বলার হয়তো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু যাঁর জন্য লিখছি তিনি যখন সুমন সরদার তখন হালকা মেজাজে পথ চলার কোনো অবকাশ নেই। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন-

                 "আমি দাঁড়ালেতো

                 তাবৎ সভ্যতা থেমে যাবে;


                 আমিও পাথর হয়ে যাবো।"

                                 (ব্যাখ্যা/বিপন্ন বসবাস)

ইয়েট্‌স তাঁর জীবনের শেষ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি, মৃত্যুর মাত্র সাতদিন আগে 'ব্লাক টাওয়ার' এ কালো দূর্গপ্রাসাদকে রক্ষা করছে অক্ষম কতগুলি সৈন্য; কবিতাটির মধ্যে অসম্ভব বোধ জড়িয়ে আছে। বাতাস গর্জন করে পুরাতন হাড়-পাহাড়ের ওপর, দূর্গ প্রাসাদের বুড়ো রাঁধুনিই কল্পনায় সত্যকে জেনেছে আর সুস্থ যুক্তিবাদী মানুষেরা নিদ্রামগ্ন থেকেছে। এটিই যেন বাস্তব, কবি নিজেকে প্রস্তুত করেন সত্যচেতনায়। মানুষের বিবেক প্রকৃতপক্ষে ঘুমিয়ে থাকতে পারে না, তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কবির সাথে কবিতার সশব্দ আহ্বানে কেউ কেউ এ ঘুম থেকে জেগে ওঠে। যে শব্দের আহ্বানে ঘুমন্ত বিবেক জেগে ওঠে, তাই হচ্ছে কবিতা। সেই কবিতার সাথে সুমন সরদারের সংলগ্নতা ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এ প্রতিধ্বনি আমরা যেমন শুনতে পাই-

                 "পাহাড় কেটে সাগর গড়ে

                  এক হাতে তার কোদালখানি

                           আরেক হাতে আগুন

                  সঙ্গী আমার সাহস করে

                  মরতে গিয়ে বেঁচে থাকে

                           বয়েস ওঠে দ্বিগুণ।"

                                 (ছাই হলো সে অনেকখানি/বিপন্ন বসবাস)

যতদিন প্রেমের দুঃখ আসে নি ততদিন মানুষের ছবিও তার কান্নায় ঢাকা পড়েছিলো ঘরের ছাদে চড়ুইয়ের চিৎকারে। দুঃখবিলাসী মন কবিতার বুকে খুঁজে পায় অনন্তের ধূসর মাঠ। সেই মাঠ থেকে উঠে আসে কবিতার ভ্রূণ। কবি সযত্নে নিজের রক্তে মিশিয়ে নেন তা। আর সময় মতো প্রসব করেন আগামী স্বপ্ন। এ প্রেক্ষাপটে সুমন সরদারের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন-

                 "ভোরের শিশির হয়ে জন্ম নেয়া ভালো ছিল

                 ঘাসের ডগায় ঝুলে হিমেল আবহ রচনার

                 মোক্ষম সময়ে এসে তোমার দু'টো পা অবশেষে

                 জড়িয়ে নিতে তো পারতাম।"

                                 (বিকল্প ভাবনা/বিপন্ন বসবাস)

সমুদ্রের গর্ভ থেকে যে সৃষ্টিশক্তি কুয়াশার রহস্যের ওপরে ওঠে, সেই শক্তিই উদ্ভিদ বা বৃক্ষকে জন্ম দেয়, পুষ্টি সাধন করে, দুঃখ থেকে রক্ষা করে। এই কুয়াশাময় নারীশক্তি অ্যাকিলিসের মাতা থেটিস। থেটিসও পুত্রকে রক্ষা করেছিলেন, তার আগে তাকে পালন করেছেন উদ্ভিদ বা বৃক্ষের মতো। সুমন সরদার চিন্তায়, প্রজ্ঞায় কবিতাকে রক্ষা করে চলেছেন সেই থেটিসের মতো। কবিতা যেন তাঁর সন্তান, তাঁর আদরে কবিতা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত যুবক। 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' কাব্যগ্রন্থের 'শব্দহীন বোধে' তিনি বলেন-

                 "জননী দাঁড়িয়ে আছে কোলে নিয়ে এক কালপুত্র-

                 কাকে ছোঁবে বৃত্ত থেকে হাতদুটি সহসা বাড়িয়ে?"

এ কালের মানুষ মৃত্যু সৃষ্টি করেছে নিজের শূন্যতা দিয়ে। সুমন সরদার এই শূন্যতা তেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তবে তিনি নির্জন একাকীত্বের গর্ব নিয়ে তৃপ্ত থাকতে চেয়েছেন আর সেটিইতো একালের বোধের প্রকাশ। আত্মচৈতন্যের মধ্যে ভয়ংকর অগ্রগতি আছে। বোদলেয়ার যেমন তাঁর কবিতায় এগিয়ে গিয়ে নির্বিদের মরুভূমিতে আতঙ্কের মরুদ্যান দেখেছেন। এ যেন প্রাণের পরাভূত অবমাননা; এই মরুদ্যান নিজে তৈরি করে নিজেকেই তা অতিক্রম করতে হয়। এখানে বলা যায় না এই অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে আমি কি করবো? সুমন সরদার সেই ভয়ঙ্কর সত্যকে তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। তবে নিরাশ হন নি কখনও। এ যেন এক ডুবসাঁতারের খেলা। জীবনানন্দ তাকেই বলেন 'বোধ', এর নাম বিপন্ন বিস্ময়-

                 "চিতার বুকে আগুন দিয়ে রাতে

                 অতীত কোন জন্মখরা

                 সঙ্গোপনে অপাপ-জরা

                 কি হবে আর মগ্ন থেকে তাতে!"

                                 (ভাবনাগুলো আবার ঘরে এলো/আগুন রঙের ডানা)

কবিতার আঙ্গিক রূপ অনুসরণ করেও সুমন সরদার নিজেকে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ধারায়। প্রতিনিয়ত তিনি ভেঙে ফেলেন তাঁর ধ্যান ও ধারণা। কবিতার আধুনিকায়নেও তিনি অতিমাত্রায় ছন্দসচেতন। যেটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত, তিনি তাঁর নিজস্ব চেতনায় উদ্ভাসিত। তিনি আধুনিক ও প্রগতিবাদী। তাঁর কবিতায় এক অসীম ক্ষুধা আছে অনন্তের জন্য। কবির উচিৎ কামনা আর অজ্ঞতার পরিবর্তে আত্মিক গৌরবকে প্রকাশ করা। সুমন সরদার সেই দীক্ষায় দীক্ষিত। বিষয় নির্বাচনে তিনি যেন অনেক কবিকেই ছাড়িয়ে গেছেন। বিমূর্ত অথচ এতো সাবলীল লেখা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। সুমন সরদার এ কাজটি করেছেন তাঁর মেধা দিয়ে। সুমন সরদারের কবিতা পড়লে বোঝা যায় তিনি বর্তমান আধুনিক সভ্যতার সাথে অত্যন্ত সফলভাবে মিশতে পেরেছেন। এই পারাটাই হচ্ছে কবিতা, আর যিনি তা পারেন তিনিই কবি। জীবনানন্দ দাশের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, 'সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি'। সুমন সরদার অবশ্যই সেই কেউ কেউ-এর দলের একজন।

                 "একদিন সবকিছু পেয়ে যাবো শোন খুকু

                 বললাম অপরূপ কিশোরীর উদ্দেশে

                 দেখে নিও উজ্জ্বল চাঁদ-আলো আসবেই

                 তাই আমি পেতে দিই শরীরের সবটুকু"

                                 (পর্যায়ক্রম/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

* শেখ নজরুল কবি ও আবৃত্তিকার।

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies