গত শতাব্দীর নব্বই দশকের জীবনবাদী কবি সুমন সরদারের 'মানবযাত্রা' র্(যামন পাবলিশার্স,
ঢাকা, ২০০৪) কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি, সমাজ, স্বদেশ, স্বকাল, প্রেম ও নান্দনিকচেতনাসহ
মানবসম্ভাবনার ইতিবাচক আশ্বস্ততা অভিব্যক্ত হয়েছে। সুমন মানবজীবনকে উপরিতল থেকে না
দেখে ভেতরতল থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার অন্তনির্দেশে কাব্যশৈলীতে
সে অভিজ্ঞানকে রূপান্তরিত করেন।
কবি সুমন সরদার এর 'মানবযাত্রা : এক' কবিতাটির মধ্যে মানবের শিকড়মুখীতার ইতিবাচক
সম্ভাবনাকে তাৎপর্যের সঙ্গে কাব্যিকবোধে বৃত করা হয়েছে। মানুষের সঙ্গে বৃক্ষের মৃত্তিকালগ্ন
সম্পর্কের গভীরতাকে কবি সমান্তরালতায় এখানে বিবেচনা করেছেন। কবি যখন লিখেন, 'মৃত্তিকা
জানে, আকাশের নীল থেকে পাতালের গভীর অবধি মানুষের শিকড়ের বন্ধন'- তখন মানবসম্ভাবনার
শক্তিমত্ততাই অভিব্যক্ত হয়। 'মানবযাত্রা : দুই' কবিতায় কবি 'ডাঙায় দাপানো মাছের মায়াবী
ঠোঁটের করুণ দৃশ্যের' রূপকে মানবের যাপিত জীবনের করুণতম অনুভবকেই রূপায়িত করেছেন।
মৃত্তিকা অর্থাৎ স্বদেশই যে জ্ঞাত কালসাপরূপী সরীসৃপ শরীরের মতো স্বদেশের কাল- কবির এ
অনুধাবনের মধ্যে আমাদের স্ব-কালের দুর্বহতার কথাই কবি উপস্থাপন করেছেন। 'চাঁদ-সূর্য
পরস্পর আলোর বর্ণনা করে করে মাতালের ঘরে শয্যা পাতে'- কবির এ পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছদ্মবেশী
ভয়ানক বিরূপাকাতর মানুষের চিত্র প্রকটিত হয়ে উঠেছে। 'মানবযাত্রা : ছয়' কবিতায় কবি লিখেছেন,
একদা সমুদ্রের মধ্যগামী উল্টোঢেউ কবিপ্রেয়সীকে অদৃশ্যের পথে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু 'কি
আছে আর কি নাই সবই দৃশ্যমান এবং যুগলভাবে সম্পূর্ণ অদৃশ্য'- কাব্যভাষ্যের মধ্যে সময়ের
নিকটবর্তী ও দূরবর্তীতার বোধ মানবের স্মৃতিময়তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে বিবেচিত হয়েছে।
'মানবযাত্রা : সাত' কবিতায় কবি তাঁর শৈশবের সময়ে যে নমনীয় সুন্দরতা দেখেছেন- তাঁর
সচেতন সমকালে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেন না। কবির মন অভিজ্ঞানের পথে ছুটে চলে বলেই তিনি
দেখতে পান।
"উর্বরা মাটি থেকে জন্মায় ক্রুশে লটকানো যিশু
পাখি ও পালক থেকে জন্মায় ভস্মের ঢিবি ... ..."
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদের সমকাল এলিয়টীয় ১৯২২-২৩ সালের ওয়েস্টল্যান্ডীয় সমকালের চেয়েও
অধিকতর ধর্মবিদ্বেষকাতর। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক আমেরিকা ও ব্রিটেন পৃথিবীতে
কোন প্রকৃত মানবায়নের বৃক্ষরোপণ করে না; তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের মধ্যে তাই 'ক্রুশে জন্মানো
যিশু'কে সচেতনজনরা প্রত্যক্ষ করে। কবি তাঁর উপর্যুক্ত কবিতাটিতে মানবীয় বোধের ইতিবাচকতার
আকাঙ্ক্ষা অভিব্যক্ত করেছেন।
কবি সুমন সরদার তাঁর 'স্তব্ধতার কাল' কবিতার মধ্যে একবিংশ শতকের উৎকেন্দ্রিক সময়ের যাপিত
জীবনের যন্ত্রণা ও বিকারকে কাব্যিক বাস্তবতায় শৈল্পিক নৈপুণ্যে তুলে এনেছেন। গোলাপ, শাপলা
ও মালতির শুভ্রতার চেয়ে সমকাল কাক ও কুকুর, শকুন ও কেউটের ভয়াবহতার তীব্রতায় হতবিহ্বল।
'রানীর বাঁধন ছিঁড়ে রাজা'র চলে যাবার রূপকের মধ্যে মানব-মানবীর অবিশ্বাস প্রবণতাই ভাষারূপ
পেয়েছে। মায়াজালে আবৃত নির্ভরতা অপসৃয়মাণ বলেই-
"রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে থাকে
জীবনের যাবতীয় সবুজ সঞ্চয়"
নুয়ে পড়া বৃদ্ধের রূপকে কবি সুমন সরদার জীবনের সামগ্রিকতাঋদ্ধ অভিজ্ঞতাকেই অবলোকন করেন।
জীবনাভিজ্ঞতার বাস্তবতাসন্ধানী কবি হলেন সুমন সরদার।
কবি তাঁর 'বিষয় : আলোর রাত্রিদিন' কবিতায় নিসর্গময়তার সঙ্গে সম্পর্কিত করে জীবনের বেদনার
রূপ-কে রূপায়িত করেছেন। বৃক্ষরা রাতের গল্প শুনতে কান পেতে থাকলেও-
"সর্ষের নিচে শিশিরের ঘাসে পাতার পতন-
কান্নার জল হয়ে ঝরে পড়ে।"
বলে প্রকৃতি ও মানবময়তার সম্পর্ককে সমান্তরালতায় এনে কবি এখানে যুগপৎ নান্দনিক ও জৈবনিকবোধের
পরিচয় পরিব্যপ্ত করেছেন।
সুমন সরদারের 'মানবযাত্রা' কাব্যগ্রন্থের 'বিষয় : আলোর রাত্রিদিন', 'আনন্দযন্ত্রণা' এবং
কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা 'বৃক্ষের দায়' এ তিনটি কবিতার প্রথমে সংকেত ও রেখাচিহ্নিত শব্দমালার
মাধ্যমে কবি মূলত জীবনের বহুরূপী সম্পর্কের বৈচিত্র্যকেই তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন।
'আনন্দযন্ত্রণা' কবিতায় অনুভবের ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামিতার সঙ্গে মানবের আনন্দ ও যন্ত্রণার সম্পর্কস্বরূপকে
প্রেয়সী অবস্থানের দোলাচলতায় কব্যিক নৈপুণ্যে কবি উপস্থাপন করেছেন।
'আলোর বর্ণনা' কবিতায় প্রৌঢ়সন্ধ্যা আসন্ন সকালের মৌন আলো বর্ণনা করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত
করে। রাতের আকাশ বৃক্ষের ডালে সংসার পাতলেও বর্ণনাকারীর আলোক-বর্ণনা দম্পতিদের শ্রবণ
করার ভাগ্য হয় না। কবি যখন লিখেন-
"দম্পতিজোড়া ঘরে ফিরে দেখে
সব ঠিকঠাক শুধু বদলেছে জায়া ..."
তখন নর-নারী সম্পর্কের রহস্যময় জটাজাল আমাদের কাছে স্পষ্টতায় আভাসিত হয়ে ওঠে।
'আমি বৃক্ষ তুমি স্বর্ণলতা' কবিতায় মানুষের বৃক্ষ হয়ে ওঠার মধ্যে মানবসম্পর্কের অবিশ্বাস-প্রবণতাকে
উৎক্রমণ করে একটি অব্যক্ত নির্ভরতায় নিজেকে সমর্পণ করার ঔদার্যের কথা অভিব্যক্ত হয়েছে। জীবনের মহৎ
বোধ এখানে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
কবি তাঁর 'জীবনপাত' কবিতার মধ্যে লিখেছেন-
"আমি শুধু আমি নই, আমাকে আমি বই, আমিতো এ আমার জাতিস্বর!"
কবির উপর্যুক্ত ভাষ্যে কবি নিজেকে জাতিস্বর বলায় এখানে তাঁর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকবোধের গভীরমূল
অনুভবের পরিব্যপ্তিই অভিব্যঞ্জিত হয়েছে।
কবি চমৎকার ছন্দমিলে তাঁর 'অভিমান' কবিতাসহ আরো অন্যান্য কবিতা রচনা করেছেন। কবি প্রেয়সীর
অপেক্ষায় কবি দিনযাপন করেন এবং কবিপ্রেমিকার অস্তিত্ব কবির কাছে 'বুকঝিম কণ্ঠহার'-এর মতো।
বৃক্ষ এবং স্বর্ণলতার রূপকে কবি নিজেকে ও তাঁর প্রেয়সীকে চমৎকার উপমায় নিম্নোক্ত পঙক্তিভাষ্যে
সজ্জিত করেছেন-
"বৃক্ষের ডাল মেলে দাঁড়িয়ে থাকি আমি জড়িয়ে তুমি থেকো স্বর্ণলতা"
কবি সুমন সরদার নান্দনিক চিত্রকল্পে তাঁর কবিতার অন্তরকে ভরিয়ে রাখেন। 'খোঁজা' কবিতায়
হরিণ ও কুমীরের রূপক রূপ সমকালের সৌন্দর্য-বিনষ্টিকেই প্রতীকায়িত করেছে। বৃক্ষ এবং সূর্যের
সমন্বয়ে মনোমুগ্ধকর একটি চিত্রকল্প (ওসধমব) আছে এ কবিতায়; তা নিম্নরূপ-
"বৃক্ষের শাখায় ঠেস দেয়া বিকেলের ক্লান্তসূর্য"।
কবি তাঁর 'মেঘচোখ' কবিতায় বৃক্ষের পাতা ঝরে যাওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রেয়সীর অপসৃত হয়ে যাওয়াকে
তুলিত করেছেন। বাঙালির শাশ্বত লোকচরিত্র পতিব্রতা বেহুলার প্রতীক্ষাপ্রবণতা কবি তাঁর প্রিয়নারীর
মধ্যে পান নি বলে 'সুনীল আকাশের সীমাহীন মেঘচোখ' কবির কষ্টের ভার বহন করে নিয়ে যায়।
কবি সুমন সরদার যে বৃক্ষ ও পাখির প্রতি কত প্রবলভাবে সংবেদনশীল, তা আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর
'আকুতি' কবিতায়। পাখিগুলো 'বৃষ্টিহীন রোদের বাগানে' কষ্ট সয়েছিল বলে মালী সারাদিন
কেঁদেছিলো। মালী আসলে কবি নিজে। পাখিগুলোর রোদে কষ্ট হয়েছে বলে মালীর মতো কবিরও
সর্বাঙ্গ পুড়ে ছাই হয়েছে-
"কী অদ্ভুত প্রেমময় স্বপ্নজালে বিদ্ধ
মালীর সর্বাঙ্গ পুড়ে ছাই হয়..."
কবি সুমন সরদার বৃক্ষের সঙ্গে তাঁর প্রিয়মানবীর স্মৃতিকে বিমিশ্রিত করে এক শিল্পনিপুণ কাব্যভাষ্য
নির্মাণ করেছেন তাঁর 'তোমাকে দেখলে মনে হয়' কবিতায়। কবির বাড়ির জামগাছের নিচে বসে কবি
যেমন দাদির গল্প শুনেছেন, তেমনি জাম খাওয়ার স্মৃতিও তার মনে পড়ে। কিন্তু জামগাছটি করাতীরা
কেটে ফেলেছে বলে-
"সেখানে এখন ছায়াহীন স্বপ্ন ঘোরে
আমার বুকের হাহাকারে স্বপ্নময় সংঘাতের সৃষ্টি হয়
তাই আজ বাড়িটিও কোলাহলহীন ..."
কবিপ্রেয়সীর পেছনে কবি যে করাতকলের লোকদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন- এর মাধ্যমে জীবনের
প্রেমময়তার করুণ-গভীর অভিব্যক্তির কথাই অভিব্যঞ্জিত হয়।
'অহংবাদী তুমি' কবিতায় কবি তাঁর প্রিয়ার শরীরী-সৌরভের কথা ব্যক্ত করেছেন। কবির হৃদয়ে
ঢিল মেরে কবিকে কষ্ট দিয়ে কবিপ্রিয়া অন্তর্হিত হয়; অথচ কবি প্রেয়সীর স্নানশেষে তার শরীর
থেকে যে ডালিমের রস ঝরে পড়ে-
"সেই ভেজা পথের সুগন্ধি ছড়ায় অনেকদূর-"
কবি তা উপভোগ করেন। কবি তাঁর প্রিয়ার অহঙ্কারে বেদনামথিত হলেও তার শরীরের সুঘ্রাণ
নিয়ে কবি বেঁচে থাকেন; এতে কবির নান্দনিকবোধের বেদনাবিহ্বল তীব্রতার প্রকাশ ঘটেছে।
কবি তাঁর 'ছেঁড়াকাগজের আত্মকথন' কবিতায় একটি রক্তক্ষরণময় চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন; যার
মর্মার্থ হলো কবিপ্রেয়সী কবিকে বারবার তুচ্ছ কাগজের মতো ছিঁড়ে ফেলে; অথচ-
"তুমি কি দেখো না-
ঝুড়ির ভেতর থেকে শতজোড়া চোখ চেয়ে থাকে
তোমার নিথর বুক বরাবর ..."
জীবনকে পাড়ি দেয়ার পথ কবি তাঁর 'অন্যকিছু খুঁজি' কবিতায় অনুসন্ধান করে স্বপ্নময়তার আকাঙ্ক্ষায়
জীবনের গন্তব্যে পৌঁছতে তিনি প্রত্যাশী। কবির জীবনযাত্রা ও মানবযাত্রার গন্তব্য তাই ইতিবাচক
জীবনময়তায় রূপাঙ্কিত বলা যায়। কবি তাঁর 'দুঃখ' কবিতায় 'অনাগত ভবিষ্যতে যেতে কতদূর-' সে
অনুভাবনা ব্যক্ত করে পাখিদের ঠোঁটে নৃশংসতার আভাস পেলেও ফুল ফোটার আশায় কবি সময়যাপন
করেন বলে জীবনানুসন্ধানের ক্ষেত্রে আশাবাদী ভূমিকায় আমরা কবি সুমন সরদারকে অবতীর্ণ দেখতে
পাই। 'বৃক্ষের দায়' কবিতায় সতী সীতার প্রতি রাজার সেনাপতির রিরংসাপ্রসূত প্ররোচনায় বৃক্ষরাও
প্রতিবাদী হয় বলে কবি যে জৈবনিক কাব্যভাষ্য প্রদান করেছেন- তাতে মানবের সত্যসুন্দর ও শালীন
বোধের সঙ্গে বৃক্ষরাজির সমান্তরাল অবস্থানের ভাষ্যসূত্রও অভিব্যক্ত হয়েছে- যার মাধ্যমে কবি সুমন
সরদারের সত্যসন্ধানী শুভ্র ও শোভন জীবনদৃষ্টির প্রতি পক্ষপাতই আমরা প্রত্যক্ষ করি।
সুমন সরদার তাঁর 'মানবযাত্রা' কাব্যগ্রন্থে জীবনবোধের সামগ্রিকতার স্বরূপ সন্ধানে ব্যপৃত হয়েছেন।
শিকড় যেমন মাটিতে স্থিত থাকে; মানবও তেমনি হবে শিকড়মুখী; অথচ তার বিস্তার থাকবে নভোমণ্ডল
অতিক্রমী- এ কাব্যিক অনুভাবনা সুমনকে কাব্যাবিষ্ট রাখে সতত। সমকালের জীবন-সঙ্কটের নেতিবাচকতায়
নিরাশ না হয়ে সুমন 'মানবযাত্রা'র 'অনাগত ভবিষ্যতে'র সদর্থ-সন্ধান করে চলেন তাঁর কাব্যাভিযাত্রায়-
সুমন সরদারের কাব্যবোধের প্রাতিস্বিকতা এখানেই অনুসন্ধানযোগ্য।
* ড. রহমান হাবিব বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
|