প্রতীক রশীদ

সুমন সরদার : নৈশব্দচারী কবির প্রতিকৃতি

নিজের সৃষ্টি এবং নিজের চেতনার মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা বড় কঠিন সাধনা। বড় মোহ। এখানে একবার জড়িয়ে গেলে আর বের হওয়া যায় না। সৃষ্টি আর চেতনাবোধ একাকার হয়ে একটি ভিন্ন মাত্রার জন্ম দেয়। সেখানে প্রেম, দ্রোহ, ভাববাদ, না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, নিজের সৃষ্ট আত্মপ্রতিচ্ছবি সবকিছু ধরা দেয়। এই সৃষ্টি তখন কাব্যিক দ্যোতনাকে ছাড়িয়ে অস্তিত্বের অন্বেষণে মগ্ন হয়। টি এস ইলিয়ট থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত কেউ-ই সেই মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তাঁরা কাব্যের অস্তিত্বের মাঝে ইতিহাস চেতনা রচনা করেছেন আর বোধ এবং মর্মে এঁকেছেন কালের চেতনা। তাই শুধুমাত্র প্রেম এবং নৈসর্গ নয়, বাস্তবতা এবং সময়ের দাবিও ফুটে উঠেছে তাঁদের কাব্যিকবোধে।

নব্বই দশকের প্রতিশ্রুতিশীল কবি সুমন সরদারও টি এস ইলিয়ট এবং জীবনানন্দ দাশের মতো সৃষ্টি আর চেতনাবোধের মায়াজালে সবেমাত্র আটকা পড়েছেন। তবে ঐ যে একটি ভয়ঙ্কর অনুভূতি এবং মোহ আছে এখানে। তাই এখান থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারেন না। পারেন নি টি এস ইলিয়ট থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত কেউ-ই। ওখানে একবার আটকে গেলে তাঁকে কবি হিসেবেই মরতে হবে, বাঁচতে হবে; অন্যকোনো পরিচয়ে নয়। তাই কবি সুমন সরদার অস্তিত্বের অন্বেষণে নিমগ্ন হয়েছেন বলেই এখন অস্তিত্ব আর ভাববাদের যোগসূত্র রচনায় নিমগ্ন তিনি একজন কবি। তাঁর কল্পনাগুলো বাস্তবপ্রসূত এবং শুধু ভাবের নয়, গতিশীলতারও।

                "দীর্ঘ শ্বাসগুলো থেমে গেলে

                প্রাচীন গন্তব্য থাকে আরো দূরে

                আবারও হাঁটতে থাকো একই কায়দায়

                এবারও সে মধুবাগ, তুমি ক্লান্ত হও

                চূড়ান্ত গন্তব্য ভেবে দীর্ঘ শ্বাস নাও!"

                                   (এক ইঞ্চিও না : বিপন্ন বসবাস)

নাগরিক সভ্যতায় বেড়ে ওঠা কবি শামসুর রাহমানের মতোই নগর এবং নগরের জীবনকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। এখানে 'মধুবাগ' ঢাকা নগরীর একটি ঘিঞ্জি পরিবেশময় এলাকা। এ শব্দটি নিজস্ব অবস্থানের প্রতিকৃতি। জীবনবোধ দ্রুত লয়ে হেঁটে হেঁটে কখনোই গন্তব্যে যেতে পারে না। সেই প্রাচীন গন্তব্যেই থেকে যায়। সেই মধুবাগে অর্থাৎ নিজস্ব অবস্থানে। এখানে সব চেষ্টা, শ্রম, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষার অপমৃত্যু হয়।

আবার 'হৃদয় জমিন থেকে' কবিতায় কবির সত্য উচ্চারণ অব্যক্ত হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটি মূলত: সময়ের দাবি, কোনো আবেগ বা কল্পনা নয়-

                "বিনিদ্র নিঝুম রাত পার হয় গোপন ভেলায়

                আমার আকাশে শুধু জমে থাকে কষ্টের ইশারা

                অলক্ষ্যে কখন যেনো প্রতারণা আঙুল খেলায়

                আমার বিদগ্ধ বুকে খানখান হয় সন্ধ্যাতারা"

                                       (হৃদয় জমিন থেকে : বিপন্ন বসবাস)

একই ভাবে কবি 'ওকে বলা হয় না' কবিতায় বর্তমান সময়ের প্রেম এবং জীবনভিত্তিক হতাশাকে এঁকেছেন সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে-

                "মধ্য দুপুরের কোনো গাছে গোলাপ থাকে না

                ঘরে ফিরে ঠিকই গোলাপের গন্ধ শুঁকি

                কষ্ট আর ক্ষোভ সঙ্গী হলে

                একদিন অবেলায় ঘরে ফিরি।

                পাশের বাড়ির বালিকাটি

                আমার দু'হাতে কিছু সতেজ গোলাপ দিয়ে বলে,

                -আপনাকে রোজ দিয়ে যাই!"

                                        (ওকে বলা হয় না : আগুন রঙের ডানা)

কবি সুমন সরদার এখানে এক আশ্চর্য হতাশাব্যঞ্জক জীবনবোধকে আবিষ্কার করেছেন। মধ্য দুপুরের মতো জীবনের অসময়ে গোলাপ অর্থে ভালবাসা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত কবি ঘরে এসে ফুলদানিতে সাজানো গোলাপ দেখতে পেলেন। কিন্তু সে গোলাপ দিয়েছে পাশের বাড়ির বালিকাটি। যে প্রতিদিন গোলাপ দিয়ে যায় কবির ঘরে। কিন্তু এ গোলাপের গন্ধ শুঁকে গোলাপকে ধন্য করা যায়। নিজের হৃদয়ের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে লাঘব করা যায় না। অথচ কবি সে যন্ত্রণার কথা কাউকে বলতেও পারেন না। একই ভাবে কবি 'কষ্টগুলো আমার থাকুক' কবিতাতেও দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়েছেন ঝরাপাতার মতো-

                 "আমি কাছে এলে যদি ঝরে যায়

                 শূন্য হয়ে যায় নিখুঁত বাগান

                 এই ভয়ে দূরে আছি দূরে থাকি!"

                                     (কষ্টগুলো আমার থাকুক : আগুন রঙের ডানা)

এখানেও কবি নিজের হৃদয়ে পুষে রাখা ভালবাসাকে প্রকাশ করতে পারছেন না। অব্যক্ত বেদনা এবং কষ্টকে একান্ত নিজের করে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। এখানেই কবির নৈশব্দচারী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

কবিরা কবিতা লেখেন। সেখানে স্থান-কাল-পাত্রের প্রভাবে তাদের নিজস্ব ভাবনাগুলো আড়াল হয়। গড়ে ওঠে ভিন্ন এক কবি সত্তা। এখানেই কবির চিন্তাশক্তির জন্ম এবং পথচলা। তাইতো Bertrand Russel লিখেছেন, "Thought is great and swift and free, the light of the world, and the chief glory of man." "চিন্তা হচ্ছে মহৎ, বেগবতী এবং মুক্ত, চিন্তা হচ্ছে জগতের জ্যোতি এবং মানুষের প্রধান গৌরব।" কিন্তু এই চিন্তা কখনও কখনও মানুষকে আত্মভোলা করে কখনও নিভৃতচারী করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনকে তাঁর কাব্যচর্চায় প্রাধান্য দেন নি। পরবর্তী সময়ে যে কয়জন শক্তিমান এবং প্রধান কবিরা চিন্তাশক্তি এবং দর্শনভিত্তিক জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে কাব্যচর্চা করেছেন, বর্তমান সময়ে প্রতিশ্রুতিশীল কবি সুমন সরদারও সেই ধারায় অগ্রসরমান। এজন্য কবি সুমন সরদারের কবিতার বোধ ও ভাষাকে বাস্তবতায় পেয়ে বসেছে।

শব্দচয়ন এবং ছন্দের ক্ষেত্রে কবি সুমন সরদারের কবিতায় যথেষ্ট স্বকীয়তার পরিচয় মেলে। এবং সেই সঙ্গে নতুন মাত্রাও। গদ্য কবিতার একগুঁয়েমি জীবন থেকে তিনি নিজেকে বাঁচিয়েছেন, বাঁচিয়েছেন ক্লান্ত পাঠকদের। পাঠক এখন গদ্যের মাঝেও ছন্দ চায়, সুর চায়, চায় অভিব্যক্তির দ্যোতনা।

'ভয়' নামক কবিতার গাঁথুনি কবি সুমন সরদারের সেই কবি চেতনাকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছে।

                 "এত কাছাকাছি বসে থাকা

                 তবু দু'জনের দূরে বসা

                 এত মুখোমুখি কথা বলা

                 তবু অনেক না বলা কথা"

আবার এই কবিতার পঞ্চম স্তবকে কবি লিখেছেন-

                 "তুমি জেনেও জানো না

                 আমিও জানি না জেনে

                 এমনও তো হতে পারে দু'জনেই জানি

                 অথবা জানি না কেউ।"

আবার নবম স্তবকে কবি বলেছেন-

                 "এতএত কাছাকাছি হাঁটা চলা

                 তবু এত দূরে চলে আসা

                 চোখে চোখে এত চোখ রাখা

                 তবু নিবিড়তা দূরে থাকা।"

                                                       (ভয় : বিপন্ন বসবাস)

কবি সুমন সরদারের সফলতা এখানেই। তিনি বর্তমান সময়ের দাবি, মূল্যবোধ, ভাবব্যঞ্জনাকে অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব স্টাইল এবং গাঁথুনি এঁটে কাব্য রচনা করেন। তিনি অনেক কবিদের মতো নিজস্ব সময়ের জীবনযাত্রার মূল্যায়ন করেছেন। তবে কাব্য চর্চায় কাউকে অনুকরণ করেন নি। আর তাইতো কবি সুমন সরদার তাঁর কাব্যচর্চার স্টাইলে কোনো পরিবর্তন আনেন নি। তাঁর 'বিপন্ন বসবাস' (১৯৯৫), 'আগুন রঙের ডানা' (১৯৯৬) এবং 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' (১৯৯৯) গ্রন্থগুলোর প্রতিটি কবিতার কাব্যিক দ্যোতনা এক এবং অভিন্ন। প্রেমের জন্য তিনি জাগতিক বা নৈসর্গিক কোনো চেতনাবোধকে টি এস ইলিয়ট কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো আত্মমগ্ন হয়ে প্রকাশ করেন নি। নিজের চিন্তাশক্তি আর বাস্তবতার নিরিখে প্রকাশ করেছেন। তাইতো তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায় এভাবে-

         "খুব দুর্বল এই হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢোকে

         নিজ সৃষ্টিতে মাতোয়ারা হয় ময়ূরের মতো

         অথচ সবাই জানে সে আমার কেউ নয়

         কোনো আত্মীয় নয়, নয় কোনো বন্ধু সুজন।"

                                  (অন্য রকম অন্য জিনিস /তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

কবির কাব্য সৃষ্টি যদি বাস্তবতা বিবর্জিত হয়, তবে তা থেকে কাব্যরস আস্বাদনে পাঠককেও কাব্যপ্রেমিক হতে হবে, হতে হবে কবিত্ব শক্তিতে উজ্জীবিত পাঠক। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে রচিত কবিতার কাব্যরস আস্বাদনে পাঠককে কোনো বেগ পেতে হয় না। যে কোনো সাধারণ পাঠকই তার কাব্যরস অতি সহজে অনুধাবন করতে পারেন। কবি সুমন সরদারের সফলতা এখানেই। তিনি খুব সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কাব্য সৃষ্টি করেন এবং তা পৌঁছে দেন সাধারণ পাঠকের মাঝে। তাইতো তিনি নিজে বাস্তব জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, শোক, দুঃখ, কষ্ট সবকিছুকে পাঠকের বুকে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। এর কারণ তিনি নিজে হচ্ছেন একজন নৈশব্দচারী মানুষ আর এই নৈশব্দচারিতাই তাঁর নির্মাণকে কবিতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যেমন, এর প্রমাণ আমরা পাই-

                 "আগুনও তো ছাই হয়- যখন মা পাথরের মতো!

                 সারারাত জেগে জেগে শীতের ভেতর

                 একা একা তোলপাড় করি নদী, পাহাড়-পর্বত!

                 চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে নয়মাস যুদ্ধ হলে

                 পৃথিবীর তাবৎ সভ্যতা বাঁচে-

                                  মা যে বড় খুশি হন দেখে।"

                                  (মা যে বড় খুশি হন : তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

ব্যক্তিজীবনে হাসিখুশি মানুষ কবি সুমন সরদারকে দেখে মনেই হয় না তাঁর কবি মানস এতটা বাস্তববাদী, এখনও যেন তিনি এক টগবগে উচ্ছ্বল তরুণ। ভাবলেশহীন ছোট্ট শিশুর মতো সারল্য তাঁকে দিয়েছে বন্ধুবাৎসল্য। কিন্তু তাঁর কবিতার ভাব-বক্তব্যে তিনি এক ভিন্ন মাত্রার মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তাই কবি হিসেবে তিনি নৈশব্দচারী। এই নৈশব্দচারী কবির একটি প্রতিবাদী সত্ত্বাও রয়েছে। সেই সত্ত্বা তাঁর নিজস্ব স্টাইলের। 'সুন্দর থেকে খসে যাবে' কবিতায় কবির প্রতিবাদী আহত সত্তার প্রকাশ পায় এইভাবে-

                 "এত কষ্টের মুহূর্তগুলো যদি হয়ে ওঠে মৌন বিলাপ

                 সুরের বাগানে ফুলগুলো তবে হাসবে না আর

                 টবগুলো ভেঙে হবে খান খান

                 সুন্দর থেকে খসে যাবে লাল!

                                     (সুন্দর থেকে খসে যাবে : তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

কবি তাঁর আকাঙ্ক্ষার মৃত্যুতে আহত হয়ে ধ্বংসকে আহ্বান করেছেন। কামনা করেছেন ফুল-সৌন্দর্যের আধার টবগুলো যাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য থেকে সুন্দরের উৎস নানা রঙ যেন খসে পড়ে। এভাবেই পেলব মসৃণ ভাষায় তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন। প্রকাশ করেছেন আহত হৃদয়ের যন্ত্রণাকে। এ ধরনের আত্মগাহন কেবল একজন নৈশব্দচারী মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তাই সবকিছু মিলিয়ে সুমন সরদার সত্যি একজন নৈশব্দচারী কবির প্রতিকৃতি।

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

* প্রতীক রশীদ, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। 

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies