নাসির আহমেদ

অলৌকিকের ঘরসংসারপিয়াসী সুমন সরদারের
জন্মদিন আসুক শতবার

                 "আমি নিজগুণে পরিপার্শ্বের স্পন্দন থেকে

                  শিখে নিতে চাই অলৌকিকের ঘরসংসার

                 ফুলের সঙ্গে ভালবাসা করে ভুলে যেতে চাই

                 ঝাঁজরা পাঁজরে ক্যাকটাসের ঘা।

                 ............................"

                                 (বিস্ময় পোকা : তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

এই আত্মস্বীকারোক্তিমূলক পঙক্তিগুচ্ছের মধ্যদিয়ে অলৌকিকের ঘরসংসারপিয়াসী যে কবির পরিচয় উৎকীর্ণ- তিনি সুমন সরদার। আমার অনুজতুল্য প্রিয় কাব্যসহযাত্রী সুমনকে ব্যক্তিগতভাবে জানি অনেকদিন ধরে, তাঁর কবিতার সঙ্গেও যোগাযোগ আমার প্রায় দেড় দশকের। আমার খুব ঘনিষ্টজনদের তালিকা দীর্ঘ নয়; সেই হ্রস্ব তালিকারই একজন সুমন। সুমন সরদার কবি হিসেবে মোটামুটি পরিচিত। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের বাইরেও তাঁর একটি জগৎ ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং তাঁর প্রতিটি জন্মদিন তাঁর স্বজন সুহৃদদের কাছে যেমন আনন্দের তেমনি তাঁর কাব্যসহযাত্রী, গুণগ্রাহী বন্ধুসুহৃদ-পাঠকদের জন্যে অত্যন্ত আনন্দের। একদিকে যৌবনের পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ হওয়া, অন্যদিকে জীবনাভিজ্ঞতার দিক থেকেও আর একটি নতুন অধ্যায়ের দিকে পদপাতের সূচনা। যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে অতীত আর বর্তমানের সন্ধিক্ষণে নিজেকে আপন দর্পনে দেখে নেবারও এ এক মোক্ষম সময়। এই সময়টায় যেমন প্রবল আবেগের উচ্ছ্বাসের ফেনিল তরঙ্গ ঠেলে একটা শান্ত স্থিত কূলে পৌঁছায় মানুষ, তেমনি জীবন আর কর্মের ক্ষেত্রেও আসে নতুন চেতনা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি। সুমন সরদার যেহেতু একজন কবি, সুতরাং তাঁর জীবনের এই সন্ধিক্ষণ তাঁর কবিতাকেও একটা নতুন জীবনবীক্ষায় উজ্জীবিত করবে, নতুন পথ দেখাবে- এমন আশা করাই সঙ্গত। আমি তাঁর জীবনের তাৎপর্যবহ দিনে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। অগ্রজ হিসেবে অনুজের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছার ডালি সাজাতে সাজাতে তাঁর কবিতার কথাও কিছু বলা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

সুমন নিষ্ঠাবান কবি, পরিশ্রমীও। নিরন্তর কবিতার ছন্দ, ভাষা আর নির্মাণ কৌশল নিয়ে তিনি ভাবেন। সেই ভাবনার পরিচয় ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে যেমন পেয়েছি, তেমনি তাঁকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তাঁর কবিতা পড়েন, তাঁরাও লক্ষ্য করে থাকবেন সুমনের কবিতায় নির্মিতির একটা ব্যাপার সবসময়ই ছিল এবং তা এখনও অব্যাহত। যে কারণে তাঁর প্রথম সলজ্জ আত্মপ্রকাশে যে তীব্র রাজনৈতিক সচেতন কবির উচ্চকিত প্রত্যক্ষ উচ্চারণ, তা অনেকটাই পথ বদল করেছে 'বিপন্ন বসবাস'-এ। 'বিপন্ন বসবাস' তাঁকে কবিতার রহস্যসন্ধানী করেছে, করেছে কিছুটা জটিলও। কিন্তু 'আগুন রঙের ডানা'য় এসে আমরা আরেক সুমনকে পাই- যিনি সহজ আর জটিলের মধ্যবর্তী একটি পথ নির্মাণের চেষ্টায় নিরন্তর শব্দশ্রমিক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। মজার বিষয় মাত্র এক দশকের মধ্যেই তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' (বাংলা ভাষার প্রথম ইন্টারনেট গ্রন্থও এটি- URL ছিল : www.netblitzink.com/book/) আরও একধাপ অগ্রসর করেছে তাঁর সেই অনুসন্ধানী কবি মানসকে। একজন কবির নিরন্তর 'হয়ে ওঠা'র যে সাধনার কথা আহসান হাবীব প্রায়শ বলতেন, সেই তারুণ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টাই কবিকে নতুন কবিতা লেখায়। সুমনের কবিতা সচেতনভাবে পড়লে যে কেউ স্বীকার করবেন সুমন নিজেকে অতিক্রমের মননশ্রমে নিরন্তর রক্তাক্ত হচ্ছেন। এখানেই তাঁর যা কিছু সাফল্য-

                  "গাছ থেকে পাতা খসে গেলে কী সুন্দর নেচে ওঠে

                  তারা থেকে খণ্ড তারা খসে গেলে আলোক ছড়ায়

                  খসে পড়া কি আনন্দ জোছনার কাছে?

                  জীবন গোলাপ যৌবনের কাছে ধরাশায়ী হলে

                  কার পরামর্শে শিল্পকর্ম তৈরি হয়?

                  ........................................."

                                (আজও আমি আছি বলে/আগুন রঙের ডানা)

এমনকি গত কয়েক বছর তাঁর যে সব কবিতা পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, সেখানেও তিনি নতুন কিছু যুক্ত করতে সচেষ্টতার সাক্ষর রেখেছেন। বিশেষ করে খাঁটি মন্দাক্রান্তা ছন্দের কবিতা যেখানে প্রায় দুর্লক্ষ্য এখন, সেই জটিল আঙ্গিক নিয়ে চর্চা আমাকে মুগ্ধ করেছে-

                 "....................................................................

                 এইখানে মৌনতা ভীষণ মৌনতা তাইতো চলে যাই দেউড়ি-পথে

                 হয়ে গেছে বড় দেরি পরেছি পায়ে বেড়ি স্বপ্ন ভেঙেচুরে মেলার-ভোরে

                 দেখা হবে আসো যদি পেরিয়ে কাল-নদী নিজেকে বেঁধে নিয়ে বায়ুর ডোরে

                 একসাথে এক বাড়ি তবেই যেতে পারি আরেক জীবনের আকাশ-রথে!"

                                 (এইখানে মৌনতা)


         কিংবা


                 "......................................................................

                 টিয়েদের প্রেমজুটি পায় না কোনো ছুটি ঘরের জানালায় আগুন জ্বলে

                  আমি আজ কুপোকাত তবুও উৎপাত মদনদেবহীন শঙ্কানলে

                 আমার কি দোষ তাতে কৃষ্ণ আসে রাতে, ফেরারি আমি ঘরে আস্থাহীন

                 রসময়ী সাম্পানে কিসের সন্ধানে করে সে মন্থন ব্রহ্মদিন

                 ................................................................."

                                 (জীবনপাত)


                 "সবকিছু মনে হয় পড়ে আছে অজ্ঞাত আড়ালে

                  পাশ ফিরে দেখি পাশে কিছু নাই

                 ....................................."

                                 (এই দেহ মৃতদের)

এই যে অজ্ঞাত আড়ালকে উন্মোচনের পিপাসা- এই তৃষ্ণাই তাঁকে দূরগামী করবে, করবে লক্ষ্যমুখী।

যাই হোক এ রচনা তাঁর কাব্যকৃতির মূল্যায়নের লক্ষ্যে নয়, অগ্রজের শুভ কামনা জানানোরই স্বল্পপরিসর প্রয়াস মাত্র। সুমন সরদারের কবিতা আরও বিস্তৃত হোক।

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

* নাসির আহমেদ সত্তর দশকের বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক।

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies