হুমায়ূন মালিক

সুমন সরদার : সময় দর্পনে স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর

নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে সুমন সরদার একটি বিশিষ্ট নাম। নব্বই দশকের গোড়া থেকে দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। সৃষ্টি স্পৃহা, মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে ইতোমধ্যে তিনি সুচিহ্নিত হওয়ার মতো এক অবস্থানে। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা নানা সমস্যার শিকার। এই সমস্যা মূলত: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঙ্কট থেকে উদ্ভূত। দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিকতা, সামাজিক অনাচার, বৈষম্য, দাতা দেশ বা সংস্থার ঋণের নামে অর্থনৈতিক চক্রান্ত, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সমস্যা ইত্যাদির ভেতর মানুষের জীবন-যাপন তথা বসবাস এখন বিপন্ন। এই বিপন্ন বসবাসের উপলব্ধি শিল্পসম্মত উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন নব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি সুমন সরদার তাঁর 'বিপন্ন বসবাস' কাব্যগ্রন্থে। এ গ্রন্থে দৃঢ় এক সামাজিক অঙ্গিকার উজ্জ্বলতর ও শিল্পসম্মত-

                 "ভয়হীন ক্রোধে হেঁটে যাওয়া সময়

                 নিঃসঙ্কোচে বেঁধে রাখে নিখুঁত পোশাকে,

                 মৃত্যুহীন পৃথিবীর অনুষঙ্গী হবে

                 ছাই রঙের পাহাড়? সৈকত হারানো সমুদ্রের

                 ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা? নাকি ধু ধু মরুভূমি?"

                                 (বিপন্ন বসবাস/বিপন্ন বসবাস)

তবে এখানে অঙ্গিকারের বিপন্ন অবস্থার শিল্পিত প্রতিবেদনই মুখ্য। বিপন্ন মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশেহারা হয়ে যায়, গন্তব্য নয়, প্রশ্নই তাঁদের জন্য সত্য হয়ে ওঠে। এখানে তাই-

                 "পরামর্শহীন বন্ধ্যা নূপুরের ধ্বনি

                 বিনিদ্র রাতের সঙ্গে বসবাস করে,

                 স্বপ্নময় শিল্পকর্ম অধোমুখী পথে

                 কোথায় পালাবে? নাকি গুমরে গুমরে

                 কেঁদে যাবে অগ্নিময় বারুদের ঘ্রাণে?

                                 (বিপন্ন বসবাস/বিপন্ন বসবাস)

সুমন সরদারের পরিমিতিবোধ প্রশংসাযোগ্য। যেমন-

                 "আমি দাঁড়ালে তো

                 তাবৎ সভ্যতা থেমে যাবে;


                 আমিও পাথর হয়ে যাবো!"

                                 (ব্যাখ্যা/বিপন্ন বসবাস)

তিনি যা বলার শুধু তাই বলতে প্রয়াসী হন। এই কবি এমন শব্দ নির্বাচনে সচেষ্ট যা তার আবেগ উপলব্ধি ধারণে সুন্দরতম। কবিতা সুন্দরতম শব্দের সুন্দরতম বিন্যাস। এমন এক বিশ্বাস নিয়েই তিনি কবিতা নির্মাণে প্রয়াসী।

সুমন সরদার শুধু বিপন্ন বসবাসের কথাই বলেন না, প্রেম-ভালবাসা এবং প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের কথাও বলেন-

                 "বিরহী ভ্রমর নিজেকে পোড়ায়

                 সঙ্গমে ফেরারী হয়ে;

                 কখনও কি বৃষ্টিপাতের প্রহর

                 আসবে না কেঁপে কেঁপে?"

                                           (ভয়/বিপন্ন বসবাস)

সুমন সরদার বিষয়োপযোগী ছন্দ খুঁজে নেন অনায়াসে। যেমন-

                 "ফেলে আসা বন্দে আলী মিয়া উঠে আসে

                 কবিতায়-কবিতায়, ছড়ায়-ছড়ায়

                 ছেলেবেলা ফিরে আসে ধানসিঁড়ি পথে

                 ময়নামতির চরে বেলা-অবেলায়"

                                 (ফিরে আসে/বিপন্ন বসবাস)

সময়ের সঙ্গে কবিতার বিষয় ও মেজাজ বদলায়। একজন সচেতন লেখকের রচনায় এই বিবর্তনের চিহ্ন সুস্পষ্ট। 'আগুন রঙের ডানা'র কবি যে নব্বই দশকের উজ্জ্বল প্রতিনিধি তা তাঁর কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকে ধরা পড়ে। সন্ত্রাস, শাসকের স্বৈরাচরণ, দ্রোহ সুমন সরদারের কাব্যসত্য হিসেবে রূপায়িত। যেমন-

                 "ফিরে আসে কেউ, আবার ঘাতক

                 এমনি অতলে আবছা আলোয় সেদ্ধ কবিতা

                 উপহার দিয়ে কোনো লাভ নেই


                 শূন্যতা যদি বিদীর্ণ ক'রে আসতে না পারো

                 তবে জ্বেলে দাও মস্তিষ্কের নির্মম আলো

                 অন্তত তার মুখে ছুঁড়ে দাও আগুনের ডানা

                 অজস্র পাখি জন্মাবে তিন কালের দীর্ঘ পরমায়ু নিয়ে"

                                 (প্রতিরোধ/আগুন রঙের ডানা)

বলা যায়, কবিতার ইতিহাস হচ্ছে তার বিষয়াঙ্গিকের বিবর্তনের ইতিহাস। কবিকে এই বিবর্তনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তাঁকে ধারণ করতে হয় সময়ের চরিত্র এবং তা থেকেই তিনি নিজের জগৎ তৈরি করেন। আপন স্পৃহা অনুযায়ী সেখানে তাঁর বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সুমন সরদার বিষয়াঙ্গিকের এ সময়ের কবিতার চরিত্র সফলভাবে ধারণ করেছেন। তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্যই তাঁকে চিনিয়ে দেয়। তাঁর কবিতায় স্বচ্ছ বক্তব্য সুশৃঙ্খল আঙ্গিকের ভেতর বিশেষ এক শৈল্পিক ঘোর নিয়ে সংস্থাপিত-

                 "তবু জননীর কোলে কালপুত্র-

                 কাকে ছোঁবে হাত দু'টি সহসা বাড়িয়ে!


                  কাকে ছোঁবে হাত দু'টি সহসা বাড়িয়ে!

                  আজ ডানা জুড়ে নেমে এলো তার বিষাক্ত ছোবল

                  এ দু'দিনে বদলে গেছে সবই, শুধু বাকি

                           জননী ও কালপুত্র।"

                                 (শব্দহীন বোধে/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

সুমন সরদারের গ্রন্থ 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কবির দক্ষতা ও বৈচিত্র্য লক্ষযোগ্য। কিছু কিছু উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকল্পে তাঁর সৃষ্টিশীল ক্ষমতার পরিচয় মেলে-

                  ১. ভেনাসের কাটা দু'টি হাতের মতন

                      গ্রাস করে নিল অদৃশ্যের পথে। (কী যে ভুল ছিল)

                  ২. আমাকে ফিরিয়ে নিলে

                      বৃক্ষসমেত কেঁপে উঠেছিল উল্কার জিব (আবার ফিরে যাবো)

ঘাতক, সন্ধ্যা, মৌলবাদের চোরা স্রোতাক্রান্ত সময়ের বিরুদ্ধে সুমন সরদারের একটি সুস্পষ্ট অবস্থান ও অঙ্গিকার আছে। কিন্তু তাঁর কবিতা তত্ত্ব কিংবা শ্লোগান আক্রান্ত নয়। সুমনের কবিতা পাঠকের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে-

                 "অতঃপর ধূর্ত দুই ডানা মেলে

                           কাছে এলো ঈশ্বরের হাত

                 হাতের তালুতে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে উঠলাম

                           সুউচ্চ পিঠের স্বর্ণসিংহাসনে

                 ঈশ্বরের দুর্নিবার দ্রুতপথে

                 আমার তাৎপর্য ব্যাখ্যা হতে না হতেই

                 হাজার হাজার স্যালুট পড়লো

                                 আমার উদ্দেশে


                 সাদা-কালো কিন্তু স্বচ্ছ কাচের দেয়ালে পড়ে থাকে

                          পরবাসী জীবনের কাগজ-কলম...

                                 (পরোয়ানা/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

এ পর্যন্ত প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও সুমনের অজস্র কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং নিয়মিত তাঁর কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। বক্ষমাণ রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন অসম্ভব। অন্যদিকে বলতে হয় পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের বিষয়টি ভিন্নতর এবং সে সময় এখনও আসে নি।

সুমন সরদারের সাম্প্রতিককালের একটি চমৎকার কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যায়-

                 "মৃতদের সকল ভাবনা

                  উলঙ্গ কপালে টিপ দিয়ে বলে-

                           জেগে আছ বন্ধুবর!

                 যতদূর জানি, ওরা মিলিয়েছে

                           সুদূরের মেঘমালা ভেদ করে

                 বিছিয়ে রেখেছে শুধু এই তর্কাতীত মায়াজাল"

                                 (এই দেহ মৃতদের)

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

হুমায়ূন মালিক আশির দশকের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies