প্রাত্যহিকের রঙ কখনো কখনো বদলে/পাল্টে যায়। জীবন-চেতনার অন্য স্তরকে স্পর্শ করতে চায় যে কবিতা,
যে পর্যায়ে তার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে থাকে আবহমান রিচুয়াল। প্রাত্যহিকের আবর্তের মধ্যে সেই সত্যকে আবিষ্কার করেন
কবি। কেননা, কবিতা জীবনকে এমন নিশ্চয়তা প্রদান করে, যাতে এর প্রতিটি সত্য ও প্রতিটি অমূর্ত বস্তু তাকে
আশ্রয় করে কবিকৃতির পরিবেশ ও তাঁর ব্যক্তিসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কবির অস্তিচেতনায় যোগমিথস্ক্রিয়া ঘটে। তাকে
আঁকড়ে গড়ে ওঠে কবির নির্মিতি। সুমন সরদারের 'মানবযাত্রা' কাব্যগ্রন্থের 'এইখানে মৌনতা' অথবা 'আনন্দযন্ত্রণা'
কবিতা যদি দেখি- "এইখানে মৌনতা ভীষণ মৌনতা নীরবে বসে আছি বৃক্ষ গুনে/ ............... /
সলজ্জ ভাবনার এ কোন অবতার কপালে টিপ দিয়ে স্বপ্ন বোনে"; কিংবা, "হঠাৎ একটি মুখ/ অনুভব-দরজায় কষাঘাত
করে/ ......... / যখন থামে না- আনন্দ বা যন্ত্রণার বহুদর্শিতায় সিক্ত হয় / তখন আবারও আরেকটি মুখ /
অনুভব-দরজায় কষাঘাত করে......" ; তাহলে দেখতে পাবো, কবিতার অবলম্বন হিসেবে রয়েছে বাইরে ছড়ানো
বস্তুবিশ্ব, তার দ্বারা বা তার সহযোগিতায় কবি তাঁর রচনাকে নিয়ে আসেন একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাঁধুনির মধ্যে, তারই কাছের
অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কবিতা ও পাঠকের মধ্যে একটি সাঁকো সহজেই তৈরি করে দেন কবি এবং সেই সঙ্গে পাঠকের কাছে
অনায়াসে স্পষ্ট হয় কবির অন্তরীণ আবেগ। বিস্তারে ও বিশ্লেষে কবি সেই আবেগকে নির্মাণ করেন। এর ফলে, কবিতার শব্দের
সঙ্গে কবির একটি দ্বৈরাজ্যময় সম্পর্ক তৈরি না হলেও, একটি আড়াআড়ি সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তাকে আশ্রয় করে কবির সংঘাত-
সীমায় দাঁড়ানো উৎক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলো বিশেষ দাবি নিয়ে জেগে ওঠে। কেননা, যাপনের সঙ্গে তার উচ্চারণের নিবিড় সঙ্গতির এক
চিত্ররূপও তৈরি হয়। এটাই কবিতার আধার, কবির উপজীব্য।
কিন্তু কথা হলো, এই যে উপলব্ধি, তার প্রতীতি- তাকে কতটা ব্যাখ্যা করা যায়। কতটা দৃশ্যমান
হয়ে ওঠে, কিংবা এর কতটাই আমাদের সনাক্তের নির্ণেয়তায় মেলে। বোধ যে উক্তি ও উপলব্ধিকে মূর্ত করে তোলে অর্থাৎ
উক্তি ও উপলব্ধিকে আশ্রয় করে বোধের যে সম্প্রসারণ, তাকে কতটা চারিয়ে নেয়া যায়, তারই প্রতিফলন দেখি সুমন সরদারের
'চাঁদ-সুরুজের সন্তানদের কথা' কবিতায় এভাবে- "মহা-অগ্নির জিভের ডগায় / সাবধানে খেলো আগুনের খেলা /........ /
যেখানে এখনো অবিরাম পাতে সূর্যালোকের ঘরসংসার..." কেন সমস্ত অবিন্যস্ত সময়কে আত্মস্থ করে নেবার আয়োজনে কবির
শব্দকে বাজিয়ে তোলার প্রয়াস? শব্দের সঙ্গে সময়ের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেবার প্রয়োজনেও কি কবিকে কখনো ধরতে হয় ছন্দমিলের
ভরাট আয়োজন? কবি সুমন সরদারের 'দুই রমণী একটি গোলাপ' কবিতায় সেই চিত্রকে দেখি- 'পালিয়ে যাবার/ পথটি কোথায়?/
পেছন দিকের দরজাটা/ তালায় মোড়া/ সদর পথের দরজাতে দাঁড়িয়ে ওরা!/ ...../ সন্ধিপত্র হয় না লেখা/ দুই রমণীর কাছে/
গোলাপটাতে হাত বাড়ালে/ দুই রমণীই নাচে!' [আগুন রঙের ডানা, ১৯৯৬]।
আত্মতাহীন সময়ের মধ্যে সেই আত্মসচেতনার আহ্বান, যার ধ্বনিতে দেখা যায় অন্য অন্ধকারের বর্ণনা এবং
প্রায় একই আবেগ নিয়ে তাঁর কাছে তাই সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, এটা কি সঙ্গত? না অসঙ্গত? সঙ্গত ও অসঙ্গতের এই দ্বন্দ্বের
মধ্যে দাঁড়িয়ে এক জটিল অথচ নিবিড় ঐক্যের বোধ নির্মাণের ধ্বনি আমরা শুনতে পাই।
একজন তরুণ কবির মূল লক্ষ্য থাকে মোচড়ের তুলনায় কবিতাকে আবেগের তীব্রতায় গ্রন্থিত করা। সেক্ষেত্রে
সুমন সরদার অনেকটাই সফল। তার কারণ, কবিসত্তার বৈশিষ্ট্যের তীব্রতায় তাঁর কবিতা আপ্লুত। তাঁর কবিতা পাঠকের সঙ্গে সেই একাত্মতা
তৈরি করে দেয়। তার প্রধান কারণ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অভিক্ষেপ তৈরির প্রয়াস লক্ষযোগ্য। সিক্ত হোমানলে আত্মলীন হয়ে থাকা কবি কেন
সন্ধ্যার আকাশে নিঃস্ব হয়ে আছেন। কে তাকে রেখে গেল এমন নিঃসঙ্গ করে, তার কারণ কি, এটা তাঁর জানা নেই। তাই তিনি বাতাসের সঙ্গে
কথা বলেন, কিন্তু এই প্রিয়তম বাতাসে তিনি কাঁকনের ঝিনিঝিনি শুনেন না। অসহায় কবি ইন্দ্রজিতের রেখায় বসে থাকেন, নিভৃতে তাঁর বুকে
জেগে থাকা পথে, যেখানে একদিন কবি তাঁর ভালবাসার হাত ধরে ভেসে যেতেন মেঘের কপালে সিঁদুরের রঙ মেখে। কিন্তু সেইসব আজ অস্পষ্ট,
ঝাপসা। তবু কবি আজও স্নানরত তার অপেক্ষায় বসে আছেন। সেখানে কোনো ফুল নেই, কোনো পাখি নেই, ভ্রূণ ধারণের কোনো বৃক্ষ নেই।
কেবল হাহাকার, আর হাহাকার।
কিন্তু যাপনের সঙ্গে কবির উচ্চারণের গভীর কোনো সঙ্গতি কি আছে কোথাও? 'অন্ধকার রঙের আশ্রয়ে যাই-,
সহিষ্ণু রাতের অন্ধকারও স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে ওঠে আজকাল'। সামাজিক স্বপ্নের মধ্যে মানুষের সহস্রধারা মন কি সহজেই বন্দি করা যায় এক
কাঠামোর মধ্যে। তাই ব্যক্তি ও সমাজ, আলো ও অন্ধকার, আসক্তি ও বিদ্রুপের মধ্যে যাপিত জীবনের নানা মুহূর্তের খণ্ডতা। এই খণ্ডতাগুলো
একে অন্যের সম্পৃক্ত হয়ে বেঁচে উঠতে চায়। তাই এই বিদ্রোহ। আপাত বিপরীত সমস্ত বৃত্তির প্রবহমানতা। তাই কবির উচ্চারণ- 'তোমরা কেমন
যুদ্ধবাজের ঘোড়া দাবড়াও/ যেখানে এখনো অবিরাম পাতে সূর্যালোকের ঘরসংসার...'। [চাঁদসুরুজের সন্তানদের কথা, মানবযাত্রা]
এছাড়া কবির বোধের বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করার যে স্বতঃস্ফূর্ত চেষ্টা, তা যে কোন পাঠকের চোখে পড়বে। কেননা মেধা আর হৃদয়, যুক্তি আর জাদু,
স্বচ্ছতা আর মায়াবী, ব্যক্তি আর সমাজ, শঠতা আর ক্ষোভ, বিদ্রোহ আর নম্যতা, বিদ্রূপ আর আসক্তি, ইত্যাকারের মধ্যে নিরন্তর
যাওয়া-আসা করেই বেঁচে থাকা জীবনের নানা মুহূর্তের খণ্ডতা, অর্থাৎ জীবনের ব্যাপক বিন্যাসের মুখোমুখির পাশাপাশি মূর্ত হয়ে ওঠে তার
মধ্যে কবি ও তাঁর কবিতা জগৎ। যেমন তাঁর 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' কবিতাটি দেখা যাক- 'স্বপ্নের ভেতর দেখি তুমি এক আশ্চর্য আকাশ/
আমার মধ্যাহ্নে এক সূর্য মেলে ধরো/ আমিও তোমার সূর্যে স্নান করে/ আবার প্রত্যুষকালে ফিরে যেতে চাই' [তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়,
১৯৯৯]। এতে সমকালীন জীবনের ছবি দৃশ্যমান, কিন্তু এর চেতনাকাঠামোর দিকে লক্ষ্য করা গেলে দেখা যাবে, তার ধারাবাহিক পার্থক্য-
যা কবিতার চেতনাগত অন্তর ঐক্যকে মূর্ত করে তোলে। কেবল সমকালীন জীবনের ছায়ায় নয়, এখানে কবির ব্যক্তিগত জীবনের সঞ্চয় স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে। এ সঞ্চয় নিয়ে কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাঁকো তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে অতীতের অবসান আর ভবিষ্যতের প্রার্থনা জড়ানো এক
বর্তমানের ছায়া। তবে আর্তি তীব্র না হলেও পাঠকের চেতনায় তার ফোকাস পড়ে। কিন্তু কোনো ব্যঞ্জনা সম্পন্ন হয়ে ওঠার চেয়ে অর্থবিচ্ছুরণের
সম্ভাবনা তৈরি করে।
তবে এর নেপথ্যে যা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে তা হলো শব্দ। শব্দ যখন বুঝিয়ে দেয় সে হয়ে উঠছে আলাদা
একটি সত্তা, তখন সে যে কোন যোগাযোগ বা সংযোগের বাহন হয়ে থাকে না আর, সে তখন উপলব্ধির ও চেতনার সংবেদ। এই সংবেদনাকে
দেখি, "তবু কিছু দৃশ্যপট আর অমুদ্রিত ভালবাসা / ধুয়ে মুছে আরও ফর্সা করে দেয় ...." (স্তব্ধতার কাল) কিংবা ".....
সাতরঙা অসুরের এমন বাহারি আক্রমণে / আগুনের পিণ্ডে ডানা ঝাপ্টে মরে যেতে মন চায়" (মানবযাত্রা : চার), তখন যাপিত জীবনে
যে সমস্ত লক্ষ্য কেন্দ্র হয়ে উঠছে, হয়ে উঠছে জীবনের মূল অন্বিষ্ট একদিকে যেমন, অন্যদিকে তেমনি শব্দ-সাজানোর চাতুর্য ছাপিয়ে জীবন ও
শিল্পের চরিতার্থকে সমার্থক করে তোলে। আর তাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে এক হিরণ্ময় নিভৃত আয়োজন, যা শব্দকে করায়ত্ব করে কিংবা শাণিত
করে তোলেন কবি জীবনের সঙ্গে; আর এর ফলে কবি যাপনের চারপার্শ্বে ঘটমান পরিস্থিতির অবগুণ্ঠন করে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন কবি
সুমন সরদার, যা রৈখিক ও সরল হলেও পাঠকের চেতনাকে ব্যঞ্জনায়, দ্যোতনায় মূর্ত করে রাখে।
(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)
* হামিদ রায়হান কবি ও প্রাবন্ধিক; কবিতা বিষয়ক ছোট কাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর সম্পাদক।
|