কবি সুমন সরদারের কবিতার সাথে বহুদিন হলো সখ্য রয়েছে। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ- 'বিপন্ন বসবাস',
'আগুন রঙের ডানা' ও 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়'- আবারও একসঙ্গে নিয়ে পড়লাম। সুমন সরদার সচল কবি-
একনিষ্ঠভাবে লিখে যাচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় তাঁর উপস্থিতি নিয়মিতভাবে লক্ষ্য করি আমরা। উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থের
বাইরে বিভিন্ন দৈনিকের সাময়িকীতে প্রকাশিত কবিতাও পড়েছি, একান্তভাবে।
সুমন সরদারের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, তিনি অন্তর-তাড়নায় শান্ত-উপলব্ধি নিয়ে কবিতা নির্মাণ
করে থাকেন। কখনো কখনো কোনও কোনও পঙক্তি শব্দের অর্থ দ্যোতনায় বেশ আস্বাদনীয় মনে হয়েছে আমার।
আত্ম-উপলব্ধি উন্মোচন করেছেন কবিতায়। এক ধরনের আত্মদর্শন ব্যক্তি-নির্ভর অনুভূতিতে জেগে ওঠে, এর
ফলে এক ধরনের কৌতূহলও সৃষ্টি হয়। এভাবে তাঁর কবিতা সংযোগ সৃষ্টি করে পাঠকের সাথে। কবি জীবনানন্দ
দাশের সেই কথাই মনে পড়ে- 'কবিতা রসেরই ব্যাপার, তবে তা উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার
জিনিস।'
কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিতাসমূহ ধারাবাহিকতায়, উপলব্ধির সামঞ্জস্যে এবং একই আঙ্গিকে বেশ কাছাকাছি। ছন্দ,
উপমা, শব্দমালা সুমন সরদারের নিজস্ব-জগতেরই অন্তর্গত হয়ে উচ্চকিত হয়েছে।
'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' (১৯৯৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা 'বিষণ্ন নির্জনে' কবি বলেছেন-
"নাগরিক বেশে তোমাকে পেয়েও
কী এক সমুদ্র পেরনোর দুর্নিবার আকর্ষণে
আমার নোঙর ছিঁড়ে অথৈ যাত্রা ছিলো
দিগ্বিদিক সান্ধ্য পথে-
জলের অতল ভেবে এতদিন
কুয়াশার অন্তর্বাসে ঠোক্কর খেয়েছি"
কবিতাটিতে কবির আত্ম-আকুতিনির্ভর মানস-চেতনা এক ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে, কাঙ্ক্ষিত কাউকে না পাওয়ার
বেদনা আবেগে জেগে ওঠে।
আবার 'পদ্মা' নামের কবিতায় কবি রূপকের আদলে বেশ ঠাসবুননে লিখেছেন-
" কোন্ দ্রোহী কেড়ে নিল বাহারি প্রমত্তা সেই ঢেউ!
বুকের গভীর থেকে উঠে এসে ওই সুর আর
বাজে না, বাজে না তার নূপুরের শব্দে জলসিঁড়ি!
ধু ধু বালুচর যেন মরীচিকা হয়ে তড়পায়
অগ্নিকাণ্ড লজ্জা পায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন প্রজ্বলনে
রঙ্গপটু আগুনের হল্কা আজ তাই পরাজিত
নিজেই নিজের কাছে।"
একটি নদীর কী নিদারুণ অবস্থা, যা দুঃখ-আক্রান্ত এবং বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পতিত, এ ধরনের কবিতাও সুমন
সরদার লিখেছেন।
কবি সুমন সরদার তাঁর কবিতায় সামাজিক পরিবেশের বাস্তবতা এক ধরনের শান্ত-বলয় তৈরি করে নমনীয় ভাবে
উপস্থাপন করেছেন- 'বৈপরীত্ব' নামক কবিতায়-
"এখানে সেখানে দিনের ভেতরে নিত্য নিঝুম আঁধার লুকিয়ে
কী এক বৈরী
কী এক বৈরী রাতের আঁধারে আলোর বসতি আলোর বসতি
আলোর বসতি..."
উল্লিখিত কবিতাটির নির্মাণ-শৈলীও অন্যান্য কবিতার চেয়ে ভিন্ন। 'দূরগামী হও' কবিতায় কবি সুমন সরদার
দার্শনিক জিজ্ঞাসা মেলে ধরেন, তখন মনে হয়- কবিরা কখনো কখনো দার্শনিক চেতনায় ঝলসে ওঠেন এবং পাঠককে
বোধের গভীরে টেনে নিয়ে যান। কবিতায় বলেন-
"সাগরের বুকে নৌকার মতো ভেসে কি কখনও
গভীরের নীলে পৌঁছানো যায়?
পৌঁছানো যায় আলাস্কা হয়ে সাইবেরিয়ায়?"
কবি সুমন সরদার অক্ষরবৃত্তে বেশির ভাগ কবিতা লিখেছেন, তাতে তিনি বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য ছন্দেও কবিতা লিখেছেন
তিনি। তবে বেশির ভাগ কবিতায় মেঘ, কুয়াশা, সমুদ্র, নদী, চাঁদ, রোদ, জ্যোৎস্না, সন্ধ্যা, তুষার, ফুল, জল পুন:পুন:ভাবে
অতিরিক্ত ব্যবহার হয়েছে, যা কবির সীমাবদ্ধতা বলে আমি মনে করি। এর ফলে পাঠক হিসেবে এক ধরনের অস্থিরতা-হাইপাই অনভব করতে হয়।
কবি সুমন সরদার-এর পথ আরও সামনে পড়ে আছে, যে পথে তিনি এগিয়ে যাবেন- নিজের সামর্থ্য আরও বাড়িয়ে নিয়ে। পাঠক
হিসেবে তাঁর কবিতায় চৈতন্যের বহুবর্ণিল ব্যঞ্জনা শুধু দেখতে চাই না- দেখতে চাই- নিজের মুখ, স্বদেশের অবয়ব, কালের
জিজ্ঞাসা, জীবনের তাৎপর্যময় দিগন্ত। পাঠক হিসেবে তাঁর কবিতার সাথে সখ্য আরও জোরালো ও ঘনিষ্ঠ হোক- এই কামনা করি।
(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)
* গোলাম কিবরিয়া পিনু আশির দশকের বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক এবং কলামলেখক
|