বাদল ঘোষ

কবিতাবাদী এক মানুষের নাম সুমন সরদার

'কবিতা' একটি সর্বগ্রাসী শব্দের নাম। যদিও কথাটি নেতিবাচক বলে অনেকে বিবেচনা করবেন- তবুও তা একজন কবির জন্য, তাঁর কবি জীবনের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে। কেননা, কবি যেখানে নিজেই তাঁর চারপাশে কাব্যের অদৃশ্য স্ফটিকের দেয়াল নির্মাণ করে বসে থাকেন তখন তাঁর কাছে সবকিছু ধরা দেয় কবিতা হয়ে। তাঁর চোখের সম্মুখে তখন কবিতার জানালা থাকে খোলা। সেই জানালায় ধরা দেয় কবির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কবি তখন নিজেই সওয়ার হন কবিতার অদৃশ্য পৃষ্ঠদেশে; কখনো পাড়ি জমান তেপান্তরের মাঠে, সাত-সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে কিংবা দূর কোনো চন্দ্রালোকে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কবি বাস্তব থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়ান বরং বাস্তববোধ থেকেই কবির মনোজগতে সৃষ্টি হয় কবিতার ভিত্তিভূমি। দৈনন্দিন বাস্তব অভিজ্ঞতাই কবি-চেতনায় অক্টোপাসের মতন দানা বেঁধে থাকে। আর কবির এই বাস্তববোধ বড়ই বিচিত্র, বড়ই সুন্দর ও অসুন্দরের এক আশ্চর্য মায়াজালে আবদ্ধ। কবি তাই কখনো কখনো এই রূঢ় বাস্তবের মাঝে নিজেকে অসহায়রূপে আবিস্কার করেন আবার কখনো সেই বাস্তবতাকে নিজের মনন ও বোধ দিয়ে নান্দনিকভাবে প্রকাশ করেন কবিতার আদলে; যেখানে সেই রূঢ় বাস্তবতাও এক অনিন্দ্য-সুন্দরের মায়াজালে আবদ্ধ করে কবিকে। কবি তখন তাঁর নিজের সৃষ্টি দেখে নিজেই চমকিত হন বারবার। নিজের নির্মাণ কীর্তির দিকে ফিরে তাকান হাতুড়ি-বাটাল হাতে ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত সেই ভাস্কর্য শিল্পীর মতো- এতো পরিশ্রমের পরও সে সৃষ্টির আনন্দে আত্মহারা। অতএব কবিকে তাই বরাবরই ফিরে যেতে হয় তার কবিতার কাছে- যেখানে কবিতাই তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান, কবিতাই তাঁর একমাত্র আরাধ্য, কবিতাই তাঁর জীবন-মরণ। এই বিচারে কবিতাকে বোধহয় সর্বগ্রাসী বললে ভুল হবে না। সুমন সরদারও তেমনি একজন কবিতাবাদী মানুষের নাম- যেখানে কবিতাই তাঁকে সম্পূর্ণরূপে করেছে গ্রাস কিংবা তিনিই হতে পারেন কবিতার কাছে একটি সর্বগ্রাসী নাম। যার সমগ্র চেতনা ও মনন জুড়ে ঘুণপোকার মতন কবিতার পোকা করে বাস। সুমনের চিন্তা চেতনা, প্রাত্যহিক জীবন চলায় কবিতা সবসময় একটি অনিন্দ্য-সুন্দরী রমণীর মতো সবসময় তাঁর পাশাপাশি করে অবস্থান। সুমন তাই সবসময় ভোগেন এক কবিতা-জ্বরে। তিনি চান কবিতা যেন মায়াবী রমণীর মতো সবসময় পাহারায় রাখে ঘিরে। যেমন, 'নীরবে সারারাত রঙিন ছোট মাছ ধরার ছলে/ আমার শরীরের ওপর যত খুশি পাহারা দেবে' (চাঁদনী রাতের গল্প/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)।

আসলে সুমন কবিতা, রমণী, প্রকৃতি সবকিছুকে একাকার করে দেখেছেন তাঁর বোধের তালিকায়। কখনো তাঁর প্রিয়তম কবিতা হয়ে উঠে এসেছে একান্ত ভালবাসায়, কখনো প্রকৃতি কবিতা হয়ে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর কবিতায় যেখানে পাঠক পড়তে পড়তে হয়তো কখনো জীবনানন্দের 'ধানসিঁড়ি নদীটির কাছে' চলে যেতে পারেন অবলীলায়। যেমন-

                  "জড় ও জটিল লতাপাতা ঘিরে আছে

                  ফুলতোলা বালিকার নম্রহাত।

                  ..................................

                  কাল এসেছিল পথহারা এক পাখি

                  আজ ডানা জুড়ে নেমে এলো তার বিষাক্ত ছোবল"

                                 (শব্দহীন বোধে/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)

প্রকৃতি সুমন সরদারের কবিতার একটি আরাধ্য বিষয়। প্রকৃতিপ্রেমী এই কবি বরাবরই তাই ফিরে গেছেন তাঁর ঘাস-লতা-পাতা ঘেরা সবুজ অরণ্যে যেখানে ফুল-পাখি ও নদীর যৌথ কলতানে খুঁজে ফিরেছেন জীবনের জয়গান, আবার কখনো তিনি সেখানে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন একান্ত ভালবাসায়। প্রকৃতির প্রতি সুমন সরদারের এই ভাললাগা, ভালবাসা ও মমত্ববোধ বড়ই অদ্ভুত, বড়ই হৃদয়স্পর্শী। তাইতো এ উচ্চারণ শুধু সুমনের কণ্ঠেই মানায়-

                  "ওরা ভুলে যায় নদী ও পাখিকে

                  ওরা ভুলে যায় ফুল ও কলিকে

                  ওরা ভুলে যায় গাছ ও মাটিকে

                  ওরা ভুলে যায় প্রেম ও প্রেমীকে

                  ওরা ভুলে যায় ভাষা ও ভাষীকে"

                                 (ওরা ভুলে যায়/বিপন্ন বসবাস)

প্রকৃত বিচারে, একজন কবিই চিহ্নিত করতে পারেন মানুষের মুক্তির সঠিক পথ। মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে আকাশে উন্মুক্ত পাখিদের বিচরণ দেখে তাঁর মনে জাগ্রত করেছিল মুক্তির এক অসীম স্বাদ। তারপর কত লড়াই, কত সংগ্রাম, কতই না রচনা হলো মানুষের মুক্তিসংগ্রামের লোকগাথা। আর মানুষতো পাখিদের মতো আকাশে উড়েও মিটিয়ে নিলো তার বহুদিনের অপূর্ণ স্বাদ; তবু মানুষের জীবনে এলো না প্রকৃত মুক্তির স্বাদ! মানুষ আজও বন্দি রয়ে গেলো এক অদৃশ্য কারাগারের মাঝে। মানুষের এ বন্দিদশা আমৃত্যু তাঁকে করে দগ্ধ। তাই এ দগ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কখনো কখনো হয়ে ওঠে কবি- কবিতার হাত দিয়ে ওঠায় মুক্তির নিশান। মূলত: প্রকৃত কবিই একমাত্র মুক্ত; তাঁর দৃষ্টির সীমানা সেই অদৃশ্য দেয়াল ভেদ করে যায়। কবি তাই কখনো কখনো জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে নেয় তার ভালবাসার অর্ঘ্য-

                 "মৃত্যুপণ করে আমি জিতে নিই তোমার ঘনত্ব

                 এক দীর্ঘ বিপ্লবের সুর বাজে দ্রাঘিমার কোণে

                 গ্লোবের ঘূর্ণনে ডুবে যাই ভেতরের সুখী ঘরে"

                                 (ভেসে আছি সময়ের দীনতায়/আগুন রঙের ডানা)

সুমন সরদার আদ্যপান্তই একজন কবি। কবিতা তাই তাঁর মুক্তির একমাত্র সোপান। কবিতাকে ভালবেসে নিভৃতচারী এই মানুষটি তাই ভুলে যান তাঁর প্রিয়বন্ধু হারানোর ব্যথা; ভুলে যান তাঁর শারীরিক পীড়া কিংবা নৈমিত্তিক জীবনের উট্‌কো ঝুট-ঝামেলা। একজন কবির কবিতা আলোচনায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন মুখ্য না হলেও অনেক সময় কবিতায় কবির ব্যক্তিগত জীবন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কেননা একজন কবির ব্যক্তিত্ববোধ, জীবনচলা, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব অবশ্যই তাঁর কবিতার শব্দচয়ন, বিষয় নির্বাচন ও গঠনশৈলীকে প্রভাবিত করে থাকে। স্বভাবে বিনয়ী ও মৃদুভাষী (কখনো কখনো সরব), ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ কবির কবিতায়ও সেই ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বিষয় নির্বাচন, শব্দচয়ন ও নির্মাণশৈলী সবকিছুতেই তাঁর একধরনের পরিমিতিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এই কবি ভাবাবেগ দ্বারা তাড়িত নন। তাঁর শব্দচয়নে সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়, যা তা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই। তিনি কখনো বেহিসেবির মতো কোনো বেখাপ্পা শব্দচয়ন করেন নি তাঁর কবিতায় যা পাঠককে বিব্রত করতে পারে। তাঁর কবিতার বিষয়ে বৈচিত্র্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, সুমনের কবিতায় ধারাবাহিক এক উত্তরণ লক্ষণীয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কবিতা পর্যন্ত পাঠ করলেই একথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে কোনো পাঠকের কাছে। আর এখানেই সুমনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, বড় মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুই চলমান- সবকিছুই ক্রমাগত এগিয়ে চলছে সম্মুখপাতে; যাকে 'উন্নয়ন' প্রত্যয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। আর সে উন্নয়ন যদি ঘটে কোথাও, সে গতি যদি থেমে যায় (এমনকি জড়বস্তুর মাঝেও), তখন তা হয়ে যায় মৃত। তাই চলার নামই জীবন, আর সে চলা অবশ্যই ইতিবাচক হবে। সুমনের কবিতাও এভাবে উত্তরোত্তর এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে আর সেই যে শুরু হয়েছে তাঁর চলার পথ মূলত: 'বিপন্ন বসবাস' থেকে তা আজও অদম্য উৎসাহে চলছে ছুটে নদ-নদী-সমুদ্র-মরু পেরিয়ে কিংবা পাহাড় ডিঙিয়ে। তাই সুমন সরদারের কবিতায় তাঁর এই ধারাবাহিক উত্তরণ সত্যিই প্রশংসনীয়।

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

* বাদল ঘোষ নব্বই দশকের অন্যতম কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies