আবিদ আজাদ

তরুণ কবিতার ঈশ্বর

আস্তিক্য বা নাস্তিক্য বিষয়ে নয়- কবিতার জন্মের সঙ্গে আমার সব সময়ই মনে হয় এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরের আবহমান সম্পর্ক রয়েছে। দার্শনিকরা সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কী ভাবেন বা বলেন তার ইতিহাসই মূলত: মানব-জ্ঞানের ইতিহাস। কবিতার ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরের গূঢ়-রহস্যকে প্রকৃত কবিরাই হৃদয় ও আত্মার সংবেদনার মধ্য দিয়ে অনুভব করেন। সেই ঈশ্বর একেকজনের কাছে একেক রকম। প্রকৃত অর্থে প্রত্যেক কবির ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সঙ্গে সওয়াল-জবাবই হচ্ছে তার কবিতা। ইংরেজিভাষী আইরিশ কবি ইয়েট্‌স বলেছেন- নিজের সঙ্গে তর্ক এবং বিবাদ থেকেই কবিতার জন্ম। আমারতো মনে হয় প্রত্যেক কবির অন্তর্জগতের এই নিজেই হচ্ছেন ঈশ্বর।

জীবনানন্দ দাশের বহুল ব্যবহৃত 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' উক্তির পেছনে আমার সব সময়ই একজন ঈশ্বরের বর্তমানতার কথা মনে হয়। বোধ করি তিনি বলতে চেয়েছেন, সকলেই কবি নয় কারণ তাদের কবিতার ঈশ্বর নেই, কিন্তু যাদের কবিতার ঈশ্বর আছেন সেই 'কেউ কেউ'ই কবি। আসলে সবাই ঈশ্বরের কণ্ঠ শোনে না, কেউ কেউ শোনে।

আমাদের একালের বাংলাদেশী কবিতা, বলার অপেক্ষা রাখে না, কলাকুশলতার দিক থেকে একটি জরুরি স্বরূপ অর্জন করে ফেলেছে। একটি নির্দিষ্ট 'স্বরূপ' অর্জিত হয়ে গেলে কবিদের একটি ভয়াবহ এবং অকথিত দুঃসময়কে মোকাবেলা করতে হয়। কারণ কয়েকটি অগ্নি ও সৃষ্টিসম্ভব কাল পেরিয়ে প্রকৃত কয়েকজন কবির কবিত্বের অবদানরূপে একটি ভাষার কবিতা যখন নতুন কোনো 'স্বরূপ' করে- তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে পুনরাবৃত্তি ও অনুকরণ। শহুরে, সুসংস্কৃত ও পুনরাবর্তনের গ্রাসে পড়া সেই অভ্যস্ত চেতনার কবিতা থেকে তখন যিনি হারিয়ে যান- তিনিই হচ্ছেন কবিতার ঈশ্বর। তখনই দরকার হয়ে পড়ে স্বরূপ ভাঙার। আর সেই ভাঙনের বা তছনছ করে দেয়ার আহ্বান আসতে থাকে কবিতার ঈশ্বরের কাছ থেকে। বধির, রুচিগ্রস্ত ও ভদ্রলোকী মেকি কবিতার কারিগর-কবিরা সেই আহ্বান শুনতে পায় না। বাংলা কবিতা এখন তাই বজ্জাত ও অবিবেচক ও হৃদয়হীন বিত্তবান সমাজের তোয়াজের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, জাত ও খাঁটি কবির কবিতার জন্য অপেক্ষাই একমাত্র গত্যন্তর- সন্দেহ কী?

বাংলাদেশের নব্বই দশক, হ্যা বিগত শতাব্দীর নব্বই দশক, অর্থাৎ সদ্য-বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের কবিদের একজন, সুমন সরদারের সাম্প্রতিক কয়েকটি কবিতার আকস্মিক পাঠ থেকে আমার মনে হলো- এই কবির কবিতার মধ্যে ঈশ্বরের আহ্বান যেন দূরাগত হয়ে উঠেছে। যে জন্য সুমন সরদার উপলব্ধি করেন-

                 "সেই থেকে আমি পাপি টিয়ের মুখে কাঁপি রঙিন ফড়িঙের নিরুদ্দেশে

                 জিজ্ঞাসা বারবার, পাবো কি অবতার আমাকে নিয়ে যেতে ভিন্নবেশে?

                 একদিন মৃদুস্বরে পরম ঈশ্বরে জানালো, এই তোর জনমঘর

                 আমি শুধু আমি নই, আমাকে আমি বই, আমি তো এ আমার জাতিস্মর!'

                                 (জীবনপাত/মানবযাত্রা)

মন্দাক্রান্তায় যার সাহসে কুলোয়, যাকে চুপিসারে কবিতার ঈশ্বর জানিয়ে এবং চিনিয়ে দেয় তার জনমঘর- সে কি তার চিরবহমান জাতিসত্তার স্মৃতি ভুলে যেতে পারে? পারে না। পারে না বলেই সুমন সরদার লিখতে পারেন-

                 "আমার শিকড়ে ঊর্ধ্বমুখী তুমি বয়ে বয়ে যাও

                 আমার মস্তিষ্কে, অস্তিত্বে জড়িয়ে

                 আশার সঞ্চার করে ফিরে ফিরে চাও

                 সাপের জড়ানো শিকার হয়েও আমি

                 সবকিছু হারানোর সুখ যেন খুঁজে খুঁজে পাই

                 অনুভবে দেখি সাপের শরীর নয়

                 আমার বৃক্ষের ডালে তুমি জড়িয়েছ স্বর্ণলতা

                 যেন বা মুকুট পরে দাঁড়িয়ে একাকী আমি আজ

                           এই বিশ্ব চরাচরে মহিয়ান রাজা


                 বৃক্ষ কোনো ছলনা জানে না, তাই

                 কখনো কখনো মানুষ নিজেই বৃক্ষ হয়ে ওঠে"

                                 (আমি বৃক্ষ তুমি স্বর্ণলতা/মানবযাত্রা)

কিন্তু সতত বিরূপ বিশ্বে নিজের নৈঃসঙ্গকে যিনি অনুভব করতে পারেন- তার কাছে 'বৃক্ষ কোনো ছলনা জানে না' এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কি সম্ভব? অথবা প্রত্যেকটি মানুষ কাল ও দূরারোগ্য ক্ষমতালিপ্সার শিকার- এই তিক্ত পরিণতি সম্পর্কে যিনি সচেতন তার কাছে সবকিছু হারানোটা সুখের হয় কীভাবে? হয়, কারণ মানবজন্মের এই চরম ট্র্যাজিক উল্লাস কবিই শুধু উপলব্ধি করতে সক্ষম।

সুমন সরদারের সাম্প্রতিক কবিতাগুচ্ছ পাঠ আমার জন্য সত্যিকারের একটি আলাদা অভিজ্ঞতা। তার ইতোমধ্যে প্রকাশিত 'বিপন্ন বসবাস', 'আগুন রঙের ডানা' এবং 'তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়' কাব্যত্রয়ের মধ্যদিয়ে আমার আয়েসী, অলস ও একগুঁয়ে পরিভ্রমণ 'সাম্প্রতিক কবিতাগুচ্ছে ('মানবযাত্রা'কাব্যগ্রন্থ) এসে, মনে হচ্ছে এক স্বতোৎপ্লাবণের মধুর মোহনায় আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। আপাতত যেখানে পৌঁছেছি- সেই আত্মনিবিড় হাওয়া ও কুয়াশার মধ্যে প্রকৃতি ও মানুষের পুনঃযোগাযোগ অসম্ভব বিচ্ছিন্নতার পরদাটি কাঁপছে- দেখতে পেলাম। এই কাঁপনের মধ্যেইতো কবিকে ফেরেশতার মাধ্যমে নবুয়ত পাঠায় তরুণ কবিতার ঈশ্বর। কবিতার অরূপ আল্লাহ্‌আলা!

(কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ 'উত্তরপুরুষ'-এর প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ প্রকাশিত)

* আবিদ আজাদ সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি ও কথাশিল্পী।

কাব্যালোচনা সূচিপত্র

পরিচিতি

প্রকাশনা

কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধ

কাব্যালোচনা

ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা গ্রন্থ

Copyright © 2005 – 2006 sskobita.com All rights reserved   ||   Site designed by Byte Technologies